সুধাকর প্রিন্টিং ওয়ার্কসের আমি একজন কম্পোজিটার স্যার।
গুলজার সিং—মানে ওই মৃত লোকটাকে আপনি দেখেছিলেন কানন রেস্টুরেন্টে?
হুঁ স্যার, দিন-দুই দেখেছি অবিনাশবাবুর সঙ্গে।
কি করছিল?
আজ্ঞে চা-টা খাচ্ছিল ওরা।
সঙ্গে অবিনাশ ছাড়া আর কেউ ছিল?
আজ্ঞে আর কাউকে দেখিনি। একাই ছিল।
কোন্ সময় ওদের রেস্টুরেন্টে দেখেছিলেন?
দুদিনই সন্ধ্যার পর—মানে তখন সাড়ে সাতটা-আটটা হবে।
ওই সময় আপনি রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন কেন?
আজ্ঞে প্রেস থেকে ফেরার পথে ঐ সময় রোজই আমি ওখানে এক কাপ চা খেয়ে আসি।
ওখানে বুঝি খুব ভাল চা হয়?
হ্যাঁ স্যার। এলাচদানা-টানা কি সব মিশিয়ে একরকম স্পেশাল চা করে। চমৎকার খেতে।
স্পেশাল চা।
আজ্ঞে স্যার। ওই পথ দিয়ে মিলের সব পাঞ্জাবী লেবাররা যায়, তারা ওখানে চায়ের জন্য ভিড় করে। খুব বিক্রী।
হুঁ। রেস্টুরেন্টটার মালিক কে?
আজ্ঞে স্যার, গুলাব সিং।
পাঞ্জাবী?
হ্যাঁ। তবে অনেক দিন—প্রায় জন্ম থেকেই বাংলাদেশে আছে তো—ঠিক আমাদের মতই বাংলা বলতে পারে, পড়তেও পারে।
দশ নম্বর পল্লীর অনেকেই ওখানে চা খেতে যায় বোধ হয়?
তা ঠিক জানি না স্যার। তবে—
তবে?
দু-চারজন ছাড়া অন্য কেউ আমার নজরে বড় একটা পড়েনি। তবে আমি তো খানিকটা বে-টাইমে যাই
আর কাকে কাকে দেখেছেন?
আজ্ঞে আমাদের হীরু সাহা, অবিনাশ-অমলেন্দু, দুই ভাই, আর একদিন দেখেছিলাম সুবোধবাবুকেও।
মানে ওই সুবোধ মিত্র?
আজ্ঞে স্যার।
ওদের প্রত্যেককেই আপনি চেনেন?
চিনি।
রেস্টুরেন্টটা কেমন, পরিষ্কার?
হ্যাঁ স্যার। রেডিও আছে, রেডিওগ্রাম আছে, লেডিজদের জন্য স্পেশাল বন্দোবস্তও আছে দোতলায়।
দোতলা তো নয় রেস্টুরেন্টটা!
আজ্ঞে ঠিক তা নয়—তবে ভিতরে কাঠের আর একটা ফ্লোর আছে মাথার ওপরে, তাই বলছিলাম আর কি–
মেয়েছেলেরাও যায় তাহলে বলুন সেখানে?
নিশ্চয়ই, স্যার, যায় বৈকি। তাদের বসবার জন্য স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে কানন রেস্টুরেন্টে।
.
২৪.
সুদর্শন অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করে।
জয়ন্তবাবু!
আজ্ঞে?
কয়েক দিন আগে এই পল্লীর যে মেয়েটি খুন হয়েছে, তাকে চিনতেন না?
কে, মাধবীদি তো স্যার? নিশ্চয়ই। ভাল চাকরি করত, সুন্দর থিয়েটারও করত। একবার দেখেছিলাম মাধবীদির থিয়েটার। কি ফার্স্ট ক্লাস যে অ্যাকটিং করত স্যার মাধবীদি। আহা, আমি তো কেঁদেই ফেলেছিলাম।
তাই বুঝি?
আজ্ঞে ভারি প্যাথেটিক সিনটা ছিল কিনা।
কোথায় দেখেছিলেন থিয়েটার তার?
কলকাতার রঙমহল থিয়েটারে। আমাকে হীরু একটা কার্ড দিয়েছিল।
কে দিয়েছিল কার্ড! সুদর্শন যেন চমকে প্রশ্নটা করে।
আজ্ঞে স্যার, হীরু সাহা। খুব গায়ে জোর, দশ পল্লীর শ্রী।
পল্লীর শ্রী?
আজ্ঞে স্যার, গত বছর সবাই ওকে ওই টাইটেল আর রুপোর মেডেল দিয়েছিল।
সুদর্শন বুঝতে পারে, মানুষটা সরল এবং কিছুটা বোকা টাইপের। নচেৎ থানায় বসে অমন করে থানা-অফিসারের সামনে মন খুলে কথা বলতে পারত না।
জয়ন্তবাবু!
বলুন স্যার? আপনি লেখাপড়া কতদূর করেছেন?
স্কুল-ফাইনাল পাস করেছিলাম স্যার, কিন্তু মামা আর পড়াল না। বললে, এবার নিজের রাস্তা দেখ। কি আর করি, ঢুকে পড়লাম ছাপাখানায়।
মামা কে? কি তার নাম?
আজ্ঞে ওই যে দশ নম্বর পল্লীতে থাকে—রাধেশ্যাম—
রাধেশ্যাম।
কেমন যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই প্রশ্নটা করে সুদর্শন তাকাল জয়ন্তর মুখের দিকে।
হ্যাঁ স্যার। দেখেননি তাকে? ওই যে নরহরি সরকার-দিনরাত মুখে রাধেশ্যাম বুলি—
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় নরহরি সরকারকে সুদর্শনের। বলে, আপনি তাঁরই ভাগ্নে নাকি?
আজ্ঞে সম্পর্কে তাই, তবে রাধেশ্যাম স্বীকার করে না।
স্বীকার করে না!
না।
কেন?
গরিব বিধবা বোনের ছেলে। স্কুল-ফাইনাল পর্যন্ত পড়িয়েছে, খেতে দিয়েছে তাই যথেষ্ট–
কিন্তু ওঁর তো শুনেছি বেশ টাকা-পয়সা আছে?
হ্যাঁ স্যার ঠিক শুনেছেন। অমন ন্যালাখ্যাপার মত থাকলে কি হবে, একটি ঘুঘু। তাই বুঝি?
হ্যাঁ। আর টাকার কুমীর।
অনেক টাকা বুঝি?
অনেক।
ওই তো ছোট্ট একটা সোনা-রুপোর দোকান। সেই দোকান থেকে কত আয় ইনকাম হয়।
তা জানি না স্যার। রাধেশ্যাম যে কোথা থেকে টাকা আনে তা সে-ই জানে—তবে তার অনেক টাকা। সত্যি কথা বলতে কি, সেই কথাটা আমি জানতে পেরেছি জেনেই সে আমায় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
নরহরির তো শুনেছি বৌ নেই-এক ছেলে, এক মেয়ে!
মামীমা ছিল লক্ষ্মী স্যার। মামী মারা যাবার পরই তো রাধেশ্যাম আমাকে তাড়িয়ে দিল বাড়ি থেকে।
তা নরহরির ছেলে কি করে?
কি আর করবে! রাধেশ্যামের যাত্রার দলে সখী সাজে। লেখাপড়া তো করল না!
আর মেয়ে?
রাধা মেয়েটা বড় ভাল স্যার। লেখাপড়াতেও ভাল ছিল খুব, কিন্তু রাধেশ্যাম তাকে পড়াল না। স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে এনে বাড়িতে বসিয়ে রেখেছে। বলে বিয়ে দেব। বিয়ে দেবে না ছাই দেবে! বেটা চামার, কেবল টাকাই চেনে। স্যার, অনেক কথা রাধেশ্যাম সম্পর্কে আপনাকে বললাম, ও যেন না জানতে পারে। জানলে আমায় ঠিক একদিন খুন করে ফেলবে।
না না, জানতে পারবে না। আপনার ভয় নেই।
দেখবেন স্যার—লোকটা কিন্তু ডেঞ্জারাস। মুখে কেবলই রাধেশ্যাম বুলি আওড়ালে কি হবে, তলে তলে কেবল শয়তানী মতলব।
আচ্ছা আমি শুনেছিলাম আপনার মামা নাকি মাধবীকে বিয়ে করবার জন্য একময় ক্ষেপে উঠেছিল।