মাধবীর সঙ্গেও আলাপ করেছিল সুদর্শন একদিন ওদের বাড়িতে গিয়েই।
প্রথম আলাপের দিনই মাধবী বলেছিল, কি সৌভাগ্য, রাজার পদার্পণ কুঁড়েঘরে।
কেন ওকথা বলছেন, মাধবী দেবী? সুদর্শন কথাটা বলে হেসেছিল।
দেবী-টেবী নয়, আমাকে মিস ব্যানার্জী বলেই ডাকবেন দারোগাবাবু।
বেশ, তাই হবে। কিন্তু ওই কথা বললেন কেন? আপনাদের তল্লাটে নতুন এসেছি, একটু জানা-পরিচয় থাকাটা কি ভাল নয়?
কিন্তু আপনারা যে রাজার জাত! মাধবী একটু বাঁকা হাসি হেসে বলেছিল।
রাজার জাত মানে? সৌহার্দ্যের কণ্ঠে—খোঁচাটা যেন বুঝতেই পারেনি, এইভাবে কথাটা বলবার চেষ্টা করেছিল সুদর্শন মল্লিক।
তা বৈকি! খোদ সরকারের প্রতিভূ এবং এ তল্লাটের একেবারে হর্তাকর্তা দণ্ডমুণ্ডের বিধাতা!
সুদর্শন হেসে বলেছিল, তাই বুঝি?
নয়? ইচ্ছা করলেই তো একেবারে বেঁধে নিয়ে যেতে পারেন পাইক-পেয়াদা পাঠিয়ে!
সে যুগ আর সেই মিস ব্যানার্জি!
কে বললে নেই! মরা হাতি এখনও লাখ টাকা। তা যাক, তারপরই একটু থেমে বলেছিল, কিন্তু আপনাদের মত লোকের আমাদের সঙ্গে আলাপ করলে কি সুবিধা হবে।
কেন, কেন?
তা বৈকি! তাছাড়া কথায় বলে পুলিসে ছুঁলে আঠারো ঘা!
আবার হেসেছিল সুদর্শন মল্লিক।
হাসছেন যে?
আপনি দেখছি বেশ মিষ্টি করে হুল ফোঁটাতে পারেন!
ওমা, সে আবার কি? না, না–ছিঃ, আপনারাই হলেন আমাদের বলভরসা। আপনাদের হুল ফোঁটাব এমন ধৃষ্টতা কি থাকতে পারে! আচ্ছা চলি-আমার আবার
অফিসের টাইম হয়ে যাচ্ছে! নমস্কার।
নমস্কার।
.
০২.
মাধবীদের ঠিক একেবারে পাশের বাড়িরই সুবোধ মিত্রের সঙ্গেও সুদর্শনের ওইদিনই আলাপ। ফেরার পথে হঠাৎ দেখা।
সুবোধ মিত্র সেদিন অফিসে যায়নি। ওই দশ পল্লীরই বাসিন্দা হলেও যেন ওই পল্লীর একজন বলে মনে হয় না। বি.এ. পাস করে একটা মার্চেন্ট অফিসে চাকরি করে। রোগা দোহারা চেহারা। কালোর রঙের উপরেও একটা যেন জৌলুস আছে। চোখে-মুখে একটা বুদ্ধির দীপ্তি। জামা-কাপড়েই কেবল ধোপদুরস্ত নয়, কথাবার্তায়ও অত্যন্ত বিনয়ী ও নষ। বস্তির মধ্যে বসবাস করলেও নোকটার যে একটা রুচি আছে তা দেখলেই বোঝা যায়।
সমাদর করে ডেকে নিয়ে সুবোধ মিত্র সুদর্শনকে তার বাইরের বসবার ঘরে বসিয়েছিল।
বেতের একসেট সোফা, কাচের একটা আলমারি-ভর্তি বই। একদিকে একটি তক্তপোশ পাতা। উপরে একটি সুজনি বিছানো। এক কোণে একটি বুদ্ধমূর্তি ও ভাসে একগোছা ফুল। দেওয়ালে ঝোলানো একটি বেহালা।
গরিবের ঘরে যখন পায়ের ধুলো দিয়েছেন, এক কাপ চা অন্তত খেতেই হবে। সুবোধ বললে।
না, না—সে-সবের কোন প্রয়োজন নেই সুবোধবাবু। ওসব হাঙ্গামা করবেন না।
হাঙ্গামা আবার কি! বসুন।
সুবোধ মিত্র পরক্ষণেই ভিতরে চলে গিয়েছিল।
একটু পরে সুদৃশ্য দামী সৌখীন কাপে এক কাপ চা নিয়ে ফিরে এল, নিন।
দেখুন তো, এখন এই অবেলায় আবার চায়ের কি প্রয়োজন ছিল!
তা হোক, আপনার মত লোক এ বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েছেন–
ঘণ্টাখানেক প্রায় আলাপ করেছিল সুদর্শন মল্লিক। খুশী হয়েছিল আলাপ করে। এবং ফিরে আসবার সময় স্বভাবতই সুবোধ মিত্র তার মনের পাতায় দাগ কেটেছিল।
আরও একজন ছিল দশ নম্বর পল্লীর-কল্যাণ বসু। রোগা প্যাটার্নের চেহারা। কালো গায়ের রঙ। মাথায় ঘন চুল। অর্ধেক গাল পর্যন্ত জুলপি। রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে বিশেষ এক পার্টির চিহ্নিত লোক ওই পল্লীর। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হবে। বিশেষ রাজনৈতিক পার্টির কর্মী হিসাবে স্বভাবটা একটু রুক্ষ। এবং বেশ একটু দাপটের সঙ্গেই যেন পল্লীর মধ্যে থাকে। পৌর প্রতিষ্ঠানের একজন বি গ্রেড ক্লার্ক।
সে বলেছিল প্রথম আলাপের সময়েই, আপনি তাহলে আমাদের এ তল্লাটের নতুন ও.সি. হয়ে এলেন। যাক, টিকে থাকুন এই কামনা করি।
আমাদের আর টিকে থাকাথাকি কি বলুন, কল্যাণবাবু! কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। যতদিন রাখবে এ থানায় ততদিন থাকব। হুকুম এলেই চলে যেতে হবে। এই দেখুন না, গত বছর দুয়েকের মধ্যেই চারজন এল আবার গেল আমার আগে এ থানা থেকে। কিন্তু কেন বলুন তো?
কি–কেন?
মানে এই থানায় ও.সি.-রা এলে চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই আবার বদলি হয়ে যায়।
কল্যাণ কিন্তু সুদর্শন মল্লিকের কথার কোন জবাব দেয়নি। মৃদু হেসে বলেছিল, আপনাকে বোধ হয় অত তাড়াতাড়ি বদলি করবে না।
কি করে বুঝলেন?
আপনি বেশ এনারজেটিক। মানে?
এই দেখুন না এখানকার থানায় এসেই শুনেছি, আপনি আমাদের পল্লীতে প্রায়ই আসছেন। আচ্ছা মশাই!
কি?
আমাদের এ তল্লাটের এই পল্লীটা বড়কর্তাদের একটা হেডেক, তাই না?
কই, সেরকম তো কিছু শুনিনি!
শুনেছেন ঠিক স্যার, চেপে যাচ্ছেন।
সুদর্শন মল্লিক প্রত্যুত্তরে হেসেছিল। তবে বুঝেছিল কল্যাণ বসু গভীর জলের মাছ।
তবে কি জানেন মল্লিক মশাই,-পরক্ষণেই কল্যাণ বসু বলেছিল।
কি?
আপনি এ তল্লাটের থানার ও.সি., যেখানে সেখানে খুশি আপনার যাবার অধিকার আছে বৈকি, কিন্তু–
কিন্তু কি? বলুন না, থামলেন কেন কল্যাণবাবু?
এ পল্লীর লোকেরা পুলিসের লোকদের বড় একটা পছন্দ করে না। কিন্তু আমি তো
জানি, বন্ধু হিসেবেই হয়তো আলাপ-পরিচয় করতে আসেন, কিন্তু এরা হয়ত সাদা চোখে ব্যাপারটা নেবে না।
কেন–কেন?
হাজার হোক, আপনি তো জানেন, কথায় বলে পুলিস! ভাববে হয়ত কোন মতলব নিয়েই আপনি পল্লীতে ঘোরাফেরা করছেন!