কিন্তু তাহলেও মনে হচ্ছে, মাধবী-ওই ওয়াগন ভেঙে চুরি যারা করে এবং দীর্ঘদিন ধরে এ তল্লাটে যারা চোরা কারবার চালিয়ে এসেছে, তাদেরই দলের একজন—এ সম্ভাবনাটায় কেন যেন তার মন সায় দেয় না। ঐ দিক দিয়ে কথাটা যেন সে কিছুতেই ভাবতে পারে না।
মাধবী কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির ও showy টাইপের মেয়ে ছিল নিঃসন্দেহে এবং অফিসে চাকরি করার বাইরে তার অভিনেত্রী জীবনের মধ্যে হয়ত কিছুটা যৌন উচ্ছৃঙ্খলতাও ছিল।
কিন্তু তাই বলে অমন একটি শিক্ষিত মেয়ে চোরাকারবারীদের দলে যে ভিড়ে যেতে পারে, অতটা নিচে যে নামতে পারে—ভাবতে মনটা কেন যেন তার কিছুতেই সায় দেয় না।
তবে মনুষ্যচরিত্র নাকি বিচিত্র এবং বিশেষ করে নারীচরিত্র।
তাছাড়াও আজও কিরীটীর কথার ভাবে বোঝা গেল সাবিত্রী সম্পর্কে সে একটু উৎসুক, কিন্তু কেন? তবে কি সাবিত্রীকেই কিরীটী সন্দেহ করে।
কিরীটীর কথায় আরও একটা ব্যাপার স্পষ্টই মনে হল, এ তল্লাটের সব হত্যাব্যাপারগুলোই নাকি একই সূত্রে গাঁথা। সব কিছুর মূলে একই কার্যকারণ। এবং হত্যার বীজ ওই পল্লীর মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার মতে!
পল্লীর সকলকে সুদর্শন চেনে না। চেনার বা জানবার সুযোগও তার হয়নি আজ পর্যন্ত। তবে মোটামুটি যাদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে বা যারা তার মনের মধ্যে আঁচড় কেটেছে, তারাও যে একেবারে সবাই খাঁটি ও নির্দোষ, তাও যেন মন তার মেনে নিতে চায় না।
হীরু সাহা, খগেন পাঠক, কল্যাণ বসু, হরগোবিন্দ, নরহরি সরকার, অমলেন্দু, অবিনাশ…
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে অবিনাশ ও জয়ন্ত বোসের কথা এবং মনে পড়ে জমাদার রামশরণ সিং বলছিল, ওই জয়ন্ত বোসই গুলজার সিংকে নাকি দিন-দুই কানন রেস্টুরেন্টে অবিনাশের সঙ্গে দেখেছিল।
তাতে করে অন্তত এটা প্রমাণিত হচ্ছে গুলজার সিংয়ের এ তল্লাটে যাতায়াত ছিল। এ তল্লাটে গুলজার সিং লোকটা একেবারে অপরিচিত নয়।
আরও একটা কথা, পূর্বে মাধবী ছাড়া আরও পাঁচজন যে নিহত হয়েছিল গত তিন বছরে, তারাও পল্লীর কেউ নয়—বাইরেরই লোক।
তাদের মধ্যে দুজন ছিল যা পূর্ববর্তীদের থানার ডাইরির রেকর্ড থেকে জানতে পারা গেছে-দুজনেই বাঙালী, নাম সুধাংশু আর গোবিন্দ—দুজনেই লরী-ড্রাইভার।
আর একজন পাঞ্জাবী মুসলমান আনোয়ার খাঁ, সেও দূরপাল্লার লরী-ড্রাইভার ছিল।
একজন মাদ্রাজী সেলসম্যান একটা বিলাতি ওষুধ কোম্পানির, নাম থিরুমল ও একজনের পরিচয় যা সংগৃহীত হয়েছিল সে উত্তরপ্রদেশের লোক-মহারাজ চৌধুরী, লোকটার লরীর ব্যবসা ছিল।
গুলরাজ সিংয়ের অবিশ্যি পুরো পরিচয়টা এখনও পাওয়া যায়নি, তবে আর যাদের পরিচয় ডাইরির রেকর্ডে আছে, তারা সবাই লরী-ড্রাইভার বা লরীর মালিক।
কথাটা ভাবতে থাকে সুদর্শন।
লোকগুলো কেউ ছিল লরী-ড্রাইভার, কেউ ছিল লরীর মালিক।
অবিশ্যি থানার লিখিত ডাইরি ঐ লোকগুলো সম্পর্কে যদি সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় তাহলে কেউই তাদের মধ্যে চোরাকারবারী বলে মনে হয় না।
হয়ত আসল কারবারী যারা তার নেপথ্যেই থেকে গিয়েছে বরাবর পুলিসের সন্দেহ দৃষ্টি বাঁচিয়ে-ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আচ্ছা এমন কি হতে পারে, তারা এই দশ নম্বর পল্লীর কেউ।
তাই যদি হয় তো কে হতে পারে?
.
২৩.
চকিতে একটা সম্ভাবনার কথা সুদর্শনের মনে মধ্যে উদয় হয়। হয়ত ওয়াগন ভেঙে যেসব মাল চুরি করা হত, সে-সব কলকাতা শহরে বা অন্যান্য জায়গায় লরী করে পাচার করা হত এবং এখনও হচ্ছে।
ওয়াগন ভেঙে মাল চুরির ব্যাপারটাও গত তিন-চার বছর ধরে চলেছে-যা থানার পূর্ববর্তী অফিসারদের ডাইরির রেকর্ড থেকেই জানা যায়।
দশ নম্বর পল্লী ও তার পেছনের খোলা মাঠটার ওপাশেই রেলওয়ে ইয়ার্ড, যেখানে সব মালগাড়ি সান্টিং করা থাকে, অনেক সময় বাইরে থেকে লোডেড হয়ে আসবার পর ও এখান থেকে মাল লোডিংয়ের পরেও।
সব চাইতে বড় কথা, হত্যাগুলোও সব দশ নম্বর পল্লীর আশেপাশে সংঘটিত হয়েছে।
সব কিছু পর পর চিন্তা করলে স্বভাবতই মনে হয় একের সঙ্গে অন্যের একটা ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র কোথাও যেন আছে। আর থাকাটা কিছু বিচিত্র নয়।
সব গিঁটগুলোই সম্ভবত একটা দড়ির মধ্যেই রয়েছে।
রামশরণ জয়ন্ত বোসকে মাঠ থেকে আসার সময় সঙ্গে করেই এনেছিল, যদি সুদর্শন তাকে কোন প্রশ্ন করতে চায় এই ভেবে। জয়ন্তকে রামশরণ থানার বাইরের ঘরেই বসিয়ে রেখেছিল।
থানার ছোটবাবু সিদ্ধেশ্বর চক্রবর্তী সুদর্শনের সামনে এসে দাঁড়াল—স্যার?
অ্যাঁ? কিছু বলছিলেন মিস্টার চক্রবর্তী?
বলছিলাম স্যার, জয়ন্ত বোসকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবেন?
কে জয়ন্ত বোস?
ওই দশ নম্বর পল্লীতেই থাকে, একজন কম্পোজিটার। যে রামশরণকে বলেছে ওই মৃত ব্যক্তি গুলজার সিংকে নাকি দিন-দুই কানন রেস্টুরেন্টে দেখেছে।
হ্যাঁ, ডাকুন তো লোকটিকে।
জয়ন্ত এসে সুদর্শনের কামরায় ঢুকল।
সুদর্শন মুখ তুলে তাকাল লোকটার দিকে। বেশ নাদুসনুদুস নাড়ুগোপাল প্যাটার্নের চেহারা। দু-চোখে শশকের ভীত-চকিত দৃষ্টি।
বসুন। আপনার নাম জয়ন্ত বোস? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে স্যার।
দশ নম্বর পল্লীতেই থাকেন?
আজ্ঞে না, খুরোট রোডে থাকি।
এখানকার দশ নম্বর পল্লীতে আপনার যাতায়াত আছে শুনলাম?
হ্যাঁ স্যার, এখানে আমার দু-চারজন জানা লোক থাকে।
হুঁ, তা আপনি কোথায় কাজ করেন?