আঙুলের নখ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পশমটা একটা কাগজের মোড়ক করে সুদর্শন তার পকেটে রেখে দিল।
আরও একটি বস্তু প্যান্টের হিপ পকেটে পাওয়া গেল—ছোট একটি আমেরিকান ছয় চেম্বারের অটোমেটিক পিস্তল। পিস্তলের ছয়টি চেম্বারই গুলি-ভর্তি।
গুলজার সিংয়ের চেহারা ও প্যান্টের হিপ পকেটে লোডেড পিস্তল দেখে মনে হয় সুদর্শনের, লোকটা আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার কোন সুযোগই পায়নি হয়ত।
আততায়ী পেছন থেকে তাকে গুলি করেছে এবং খুব ক্লোজ রেঞ্জ থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে, লোকটা আত্মরক্ষার কোন সুযোগই পায়নি।
ক্ষতস্থানের চারপাশে জামার ওপরে কিছু কার্বন ডিপোজিট দেখা যায়।
পূর্বের সন্দেহটা তার মনে আরও দৃঢ় হয়, নিশ্চয় আততায়ী তার অলক্ষ্যে নিঃশব্দে তাকে ফলো করে পেছনে-পেছনেই আসছিল–প্রথম সুযোগেই পেছন দিক থেকে গুলি চালিয়েছে।
আশেপাশে কোন রক্তের চিহ্ন চোখে পড়ে না সুদর্শনের এবং কোন স্ট্রাগলের চিহ্নও। কোথাও নজরে পড়ে না তার।
২০-২৫. মৃতদেহটা দুজন সেপাইয়ের প্রহরায়
২১.
মৃতদেহটা দুজন সেপাইয়ের প্রহরায় রেখে সুদর্শন ফিরে এল থানায়।
মৃতদেহটা মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে এবং কোয়ার্টারে হোমিসাইডাল স্কোয়াডকে একটা সংবাদ পাঠাতে হবে।
সব ব্যবস্থা করতে করতে ঘণ্টা দুই লেগে গেল সুদর্শনের।
ইতিমধ্যে দশের পল্লীর বাসিন্দাদের মধ্যে সংবাদটা ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই তল্লাটে আবার একজন খুন হয়েছে। মাঠের মধ্যে ক্রমশ ভিড় জমে যায়।
রামশরণ সিং অনেককেই প্রশ্ন করে, তাদের মধ্যে কেউ গুলজার সিংকে চিনতে পারছে কিনা, আগে কখনও কেউ তাকে দেখেছে কিনা ঐ তল্লাটে!
ভিড়ের মধ্যে হীরু সাহা, খগেন পাঠক, অমলেন্দু ও হরগোবিন্দ ঘোষও ছিল।
তাদেরও রামশরণ ওই একই প্রশ্ন করে। কিন্তু তারা মাথা নাড়ে সকলেই-কেউ তারা ইতিপূর্বে লোকটাকে দেখেওনি, চেনেও না।
কেবল একজন বললে, ওকে বার-দুই দেখেছে কানন রেস্টুরেন্টে অবিনাশের সঙ্গে। তবে সেও চেনে না লোকটাকে।
যে গুলজার সিংকে দেখেছে বললে, সকলেই তার মুখের দিকে তাকায়।
চব্বিশ-পঁচিশ বছরের এক যুবক। পরিচয় জানা গেল স্কুল-ফাইন্যাল পাস করে আর পড়াশুনা করেনি। খুরোট রোডে একটা ছাপাখানায় কাজ করে, কম্পোজিটার। বেশ নাদুসনুদুস নাড়ুগোপাল প্যাটার্নের চেহারা। নাম জয়ন্ত বোস।
ইতিমধ্যে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে গেল।
মৃতদেহটা স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে মর্গে রওনা করে দিয়ে জমাদার রামশরণ সিং একজন সেপাইকে অকুস্থলে প্রহরায় রেখে থানায় ফিরে এল।
সুদর্শন তখন ফোনে কিরীটীর সঙ্গে কথা বলছিল।
হ্যাঁ দাদা, আবার একটা খুন হয়েছে কাল রাত্রে।
কিরীটী ফোনে শুধায়, তোমার ঐ দশ নম্বর পল্লীরই কেউ নাকি?
না, পল্লীর কেউ নয়।… হ্যাঁ, আইডেনটি তার পকেটেই পাওয়া গেছে। লোকটা পাঞ্জাবী-নাম গুলজার সিং।
তাহলে গুলজার সিংহকে নিয়ে খুনের সংখ্যা হল সাত! কিরীটী বললে।
তাই। তবে ওই পল্লীর একজন মাধবী ছাড়া আর সব বাইরের লোক।
তারপর মোটামুটি মৃতদেহ সম্পর্কে ও যা বুঝতে পেরেছিল সব বলে গেল কিরীটীকে ফোনেই।
তোমার কি মনে হচ্ছে সুদর্শন?
কিরীটী প্রশ্ন করে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সুদর্শনের বিস্তারিত বিবরণ শুনে।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে দাদা, সব হত্যা-ব্যাপারগুলোই এক সূত্রে গাঁথা। আপনার কি মনে হয়? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
তাই তো মনে হচ্ছে আপাতত। কিরীটী জবাব দেয়।
কিন্তু একজন ছাড়া কেউ পল্লীর বাসিন্দা নয়।
না হোক, তবু একটা কথা ভুলো না ভায়া, সব কটি হত্যাই ওই পল্লীর আশেপাশে সংঘটিত হয়েছে-যা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে একজন ছাড়া সবাই বাইরের লোক হলেও ঐ জায়গায় সবারই গতিবিধি হয়ত ছিল—which has got an importance।
সুদর্শন কোন জবাব দেয় না।
কিরীটী আরও বলে, তাছাড়া ঐ হত্যাকাণ্ডগুলোর আরও একটি দিক আছেতোমার মনে হয়েছে কিনা জানি না!
কি বলুন তো দাদা?
যদি ধরে নিই, প্রত্যেকটি হত্যার সঙ্গেই তোমার ওই দশ নম্বর পল্লীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে এবং ওই পল্লীরই এক বা একাধিক ব্যক্তির বিশেষ কোন স্বার্থের সঙ্গে ও হত্যাকাণ্ডগুলো জড়িয়ে—তাহলে–
আপনি কি বলতে চান দাদা?
সুদর্শনকে থামিয়ে দিয়ে কিরীটী বলে, যা বলতে চাই তা যদি হয় তো ওই পল্লীর মধ্যেই কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই হত্যার বীজ লুকিয়ে আছে।
কিন্তু মাধবীর হত্যার ব্যাপারটা
তুমি কিন্তু প্রথম থেকেই একটু ভুল করছ সুদর্শন!
ভুল?
হ্যাঁ। মাধবীর হত্যার ব্যাপারটাকে প্রথম থেকেই আলাদা করে ভাবার বা দেখবার চেষ্টা করছ। প্রেম বা প্রতিহিংসা হয়ত কিছু তার হত্যার ব্যাপারে থাকতে পারে এবং থাকাটা অসম্ভবও নয়, তাহলেও আমার মনে হচ্ছে—কিন্তু মূল উদ্দেশ্যটা তা নয়, মূলে হয়ত সেই একই কার্যকারণ যা গত তিন বছর ধরে এতগুলো লোকের প্রাণহানি ঘটিয়েছে।
একটু থেমে তারপর কিরীটী বলে, ভাল কথা, সাবিত্রীর সঙ্গে আলাপ কেমন হল?
কেন বলুন তো?
Dont neglect her! বলে কিরীটী ওপাশে ফোনটা নামিয়ে রাখল মৃদু হাসির সঙ্গে।
.
২২.
কিরীটীর শেষ কথাগুলো সুদর্শনকে যেন নতুন করে ভাবিয়ে তোলে।
সে ফোনটা নামিয়ে রেখে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরায়। মনে মনে ভাবে, তবে কি সে সত্যি-সত্যিই আগাগোড়া একটা ভুল পথ ধরে চলেছে?