কিরীটীকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সুদর্শনও উঠে দাঁড়ায় সঙ্গে সঙ্গে।
গাড়িতে ওঠবার পর হীরা সিং গাড়িতে যখন স্টার্ট দিয়েছে, কিরীটী বললে, সুদর্শন, ছোটবেলায় যে যোগ অঙ্ক শিখেছিলে, দুয়ে দুয়ে যোগ করে চার হয়—সে অঙ্কটা ভুলে যেয়ো না!
সুদর্শন প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসে।
গাড়ি চলতে শুরু করে। কিরীটীর শেষ কথাটা সুদর্শনের কানে আসে, দুয়ে দুয়ে যোগফল চারই হয়—পাঁচও হয় না, তিনও হয় না। কম-বেশি হবার উপায় নেই।
গাড়িটা চোখের সামনে থেকে বের হয়ে গেল।
সুদর্শন ধীর পদক্ষেপে থানায় তার অফিস-ঘরে ফিরে আসে। কিরীটীর শেষের কথাগুলো তখনও তার মধ্যে আনাগোনা করছে।
কিরীটী যে ইঙ্গিতটা দিয়ে গেল, তার অর্থ কি? তবে কি সে আগাগোড়াই ভুলপথে চলেছে? হাতের সামনে সব থাকা সত্ত্বেও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে?
হয়ত তাই। দুটো ব্যাপারের সঙ্গে হয়ত সত্যিই একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। সেই দিক থেকে অগ্রসর হতে পারলেই মাধবীর হত্যা-রহস্যটা হয়ত পরিষ্কার হয়ে যাবে।
নাঃ, আর একবার দশ নম্বর পল্লীটা তাকে ভাল করে ঘুরে দেখতেই হবে।
সত্যিই হয়ত সে বিশেষ কয়েকটা মানুষ সম্পর্কেই কেবল চিন্তা করছে বলেই আসল কালপ্রিটের কোন সন্ধানই এখনও পর্যন্ত পায়নি।
মাধবীর হত্যা-রহস্যের সঙ্গে হয়ত ওই লোকগুলোর কোন সম্পর্কই সত্যিই নেই।
নতুন করে আবার সমস্ত ব্যাপারটা আগাগোড়া ভাববার চেষ্টা করে সুদর্শন।
শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে যায় সুদর্শনের। এবং শুতে যখন যায় তখন সে ভাবতেও পারেনি, পরের দিন প্রত্যুষে জটিলতর আর একটি সংবাদ তার জন্য অপেক্ষা করছে।
একটু বেলাতেই সুদর্শনের ঘুম ভাঙে গোবর্ধনের ডাকাডাকিতে।
বাবু, বাবু—
কি রে? ভোরবেলা চেঁচামেচি শুরু করেছিস কেন?
আজ্ঞে সেপাই রামলোচন আপনাকে ডাকছে।
কেন, কি হয়েছে?
.
২০.
গরম আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে, চপ্পলের মধ্যে কোনমতে পা দুটো গলিয়ে ঘুমজড়ানো চোখে শোবার ঘর থেকে বের হয়ে এল সুদর্শন।
সামনেই দাঁড়িয়ে রামলোচন সিকদার। ছোকরা কনস্টেবল। বছর দুই চাকরিতে ঢুকেছে—যেমন চালাক, তেমনি চটপটে।
কি রামলোচন, কি খবর?
হুজুর, এ তল্লাটে আবার একটা খুন হয়েছে।
খুন! হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খায় সুদর্শন। ঘুমের শেষ রেশটুকু যেন সঙ্গে সঙ্গে চোখের পাতা থেকে মুছে যায়। বললে, কোথায়? কে খুন হল আবার? পল্লীর কেউ নাকি?
আজ্ঞে, লোকটা এক পাঞ্জাবী। দশ পল্লীর কেউ নয়।
পাঞ্জাবী?
হ্যাঁ। লোকটাকে একদিন আমি দিন-পনেরো আগে ওই যে—যে মেয়েটির বড় ভাইয়ের সঙ্গে বড় রাস্তায় যে কানন রেস্টুরেন্টটা আছে, সেই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোতে দেখেছিলাম।
ডেড বডি কোথায়?
ওই মাঠটার মধ্যে।
সুদর্শন আর দেরি করে না, চটপট জামা-কাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে জমাদার রামশরণ সিং, জনা-চারেক কনস্টেবল ও সঙ্গে রামলোচনকে নিয়ে বের হয়ে পড়ল।
মৃতদেহটা সেই মাঠের বট গাছটার সামনে পড়েছিল।
উপুড় হয়ে পড়ে আছে মৃতদেহটা। পরনে দামী ক্রিম কালারের ট্রপিক্যাল স্যুট, পায়ে দামী গ্লেসকিডের সু, মাথায় পাগড়ি, মুখে দাড়ি। পৃষ্ঠদেশের ঠিক মাঝামাঝি একটা ক্ষতস্থান। প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল মনে হয় ক্ষতস্থান থেকে।
পিঠের জামার যে অংশটায় গুলি বিধেছিল তার চারপাশ রক্তে ভেজা। লাল হয়ে আছে। মৃতদেহের হাত দুটো ছড়ানো।
দশ নম্বর পল্লীর লোকেরা বোধ হয় ব্যাপারটা জানতেও পারেনি তখনও, কারণ আশপাশে কেউ ছিল না। কাউকেই সেখানে দেখতে পেল না সুদর্শন। আশপাশের ঘাস তখনও শিশিরসিক্ত।
সুদর্শনের বুঝতে কষ্ট হয় না লোকটা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে, এবং পেছন দিক থেকেই তাকে কেউ গুলি করেছিল।
হয়ত এমনও হতে পারে, সুদর্শনের মনে হয়, হত্যাকারী লোকটাকে অনুসরণ করেছে পিছন থেকে, তারপর সুযোগ বুঝে গুলি করেছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, লোকটা এই জায়গায় কেন এসেছিল?
আরও একটা কথা, হত্যাকারী কি জানত যে লোকটা এখানে আসবে কিংবা তাকে হত্যা করার জন্যই ফাঁদ পেতে এই নির্জন জায়গায় ডেকে আনা হয়েছিল, যাতে করে হত্যাকারীর সুবিধা হয় হত্যা করতে এবং গুলির শব্দটাও যাতে কেউ শুনতে না পায়।
নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিচু হয়ে বসে মৃতদেহটা উলটে দিল সুদর্শন।
বেশ বলিষ্ঠ লম্বা-চওড়া গঠন লোকটার, যেমন সাধারণত পাঞ্জাবীরা হয়। বাঁ হাতে একটা লোহার বালা, ডান হাতে একটা দামী সোনার রিস্টওয়াচ।
পকেট হাতড়ে একটা দামী সেন্টের গন্ধসিক্ত সিল্কের রুমাল, কিছু চিউয়িংগাম ও একটা দামী চামড়ার পার্স পাওয়া গেল।
পার্সের মধ্যে লোকটার একটা ফটো ও নামধাম পাওয়া গেল।
গুলজার সিং। ১৪নং ক্যামাক স্ট্রীট। গগনচারী ম্যানসন, থার্ড ফ্লোর, রুম নাম্বার ৫৬।
আর পাওয়া গেল পার্সের মধ্যে খান-দুই একশো টাকার ও দশ পাঁচ ও এক টাকার খুচরো নোটে মোট দুইশত আটান্ন টাকা। এছাড়াও গোটা দুই পেট্রোলের ভাউচার ও ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের একটা টেলারিং শপের ক্যাশমেমো দুশো সাতাত্তর টাকা এবং একটা চাবির রিং কোটের পকেটে।
মৃতদেহের ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ ছিল। রাইগার মর্টিস সেট-ইন করায় মুষ্টিটা শক্ত হয়ে গিয়েছিল।
আঙুলে বড় বড় নখ। নখের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটা বস্তু সুদর্শনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাদা রঙের খানিকটা পশম।