কি?
কাছেই একটা জায়গা আছে, যাকে এ তল্লাটের লোকেরা দশ নম্বর পল্লী বলে থাকে–
আমিও জেনেছি সেটা।
ঐ পল্লীতে বহু লোকের বাস। অনেকদিন আগে থাকতে ঐ অঞ্চলে লোকের বসবাস ছিল, তারপর বহু ঘর রিফিউজি এসে আশপাশের পড়ো জমি জবরদস্তি দখল করে ঘরবাড়ি তুলে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করে দেয়। ফলে একটা মিশ্র অথচ যৌথ বিরাট অঞ্চল গড়ে ওঠে ক্রমশ গত পনেরো-কুড়ি বছর ধরে। এবং সকলে মিলে নাম দিয়েছে তার দশ নম্বর পল্লী।
কেন, দশ নম্বর পল্লী নাম হল কেন?
এ তল্লাটে আশেপাশে ওই ধরনের ছোট ছোট আরও নটি পল্লী আছে। অবিশ্যি ভেতরে গেলে আপনার মনে হবে বিরাট একটা কলোনী যেন। বেশ কিছু পাকা বাড়ি, ইলেকট্রিক তো আছেই-রাস্তাঘাটও চলাচলের পক্ষে ভাল করা হয়েছে
আর পল্লীবাসীরা?
শিক্ষিত অশিক্ষিত নানা শ্রেণীর মানুষ আছে। অফিসের কেরানী থেকে শুরু করে প্রফেসার, স্কুলমাস্টার, মেকানিক, মোটর-ড্রাইভার, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, বহু ভদ্র গৃহস্থ পরিবার আছে। এবং আছে সামনের অন্নপূর্ণা জুট মিলের বহু কর্মী। আমার মনে হয়, সামনের ইয়ার্ডের ওয়াগন-ব্রেকের ব্যাপারে যারা জড়িয়ে আছে, তাদের বেশ কিছু ওই দশ নম্বর পল্লীরই বাসিন্দা।
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে সুদর্শন, তোমার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে।
ও-কথাটা ভাববার অবিশ্যি আমার আরও একটা কারণ আছে দাদা।
কি?
নিষিদ্ধ অনেক ব্যাপার ওই পল্লীতে চলে। যেমন চোরা কারবার, মদচোলাই—
মিল ওয়ার্কাররা থাকলে তা তো হবেই।
আরও আছে, সুদর্শন বলে, গত তিন বছরে পাঁচটা খুন হয়েছে ওই তল্লাটে।
তাও জানি।
এবং তারা সবই পুরুষ। গত ১৯শে শনিবার শেষ খুন হয়েছে—
তাও জানি-একটি মেয়ে–
হ্যাঁ। একটি মেয়ে, তাও আপনি জানেন দেখছি! তা ওই খুনের ব্যাপারটাই আপনাকে আমি বলব ভাবছিলাম। ব্যাপারটা যেন আগাগোড়াই একটা মিস্ত্রি-ধোঁয়াটে–
মেয়েটির বয়স কত? চব্বিশ-পঁচিশ ছিল না?
হ্যাঁ। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত এক অন্ধ স্কুল-মাস্টারের মেয়ে। আই. এ. পাস করে শর্টহ্যান্ড শিখে একটা অফিসে চাকরি করছিল, আর সেই সঙ্গে—মেয়েটির চমৎকার অভিনয়-প্রতিভা ছিল, অ্যামেচার ক্লাবে অভিনয় করেও বেশ উপার্জন করত—
আর কিছু জানতে পারনি মেয়েটির সম্পর্কে?
না।
স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল?
বোধহয় খুব পরিষ্কার ছিল না।
প্রেমঘটিত ব্যাপার?
তাও তেমন শুনিনি, তবে—
কি?
ওর প্রতি সকলেরই নজর ছিল।
স্বাভাবিক। মেয়েটি বোধহয় দেখতে সুন্দর ছিল।
বলতে পারেন সত্যিকারেরই সুন্দরী।
অর্থাৎ সুন্দরী, যুবতী—
হ্যাঁ।
আলাপ হয়েছিল?
হয়েছিল। একটু যেন ফ্লার্টারিং টাইপের ছিল। সংক্ষেপে ব্যাপারটা আপনাকে বলি দাদা, সব শুনলে হয়ত আপনি মোটামুটি একটা কিছু আন্দাজ করতে পারবেন মেয়েটি সম্পর্কে।
ইতিমধ্যে শীতের বেলা ঝিমিয়ে এসেছিল। বিষণ্ণ আলোয় চারদিক ম্লান হয়ে উঠেছিল।
কিরীটী বললে, তোমার কাহিনী শুরু করবার আগে আর এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা কর সুদর্শন।
নিশ্চয়ই দাদা, এখুনি ব্যবস্থা করছি।
সুদর্শন উঠে গেল।
খোলা দরজা-পথে বাইরের স্লান বিষণ্ণ আলোর দিকে চেয়ে চুপচাপ বসে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে কিরীটী ধূমপান করতে থাকে।
বেশ শীত-শীত লাগে।
.
সুদর্শনের কাহিনী শেষ হতে ও সকলের জবানবন্দি পড়তে পড়তে রাত প্রায় নটা হয়ে গেল।
কিরীটী মধ্যে মধ্যে দু-একটা প্রশ্ন করেছে-যেমন, ওই পল্লীর যে সব লোকেদের তুমি ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছ সুদর্শন, তারা ছাড়াও তো অনেকে আছে?
তা আছে।
পল্লীর দু-চারজন বৃদ্ধ বা প্রৌঢ় ব্যক্তিকেও ডেকে তোমার জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত ছিল।
তা হয়ত ছিল, কিন্তু আমার মনে হয় দাদা–
বুঝতে পারছি সুদর্শন—ওই হীরু সাহা, খগেন পাঠক, কল্যাণ বসু, হরগোবিন্দ ঘোষ, নরহরি সরকার, অবিনাশ ও অমলেন্দু ব্যানার্জি-ওরাই তোমার মনে বিশেষভাবে রেখাপাত করায় তুমি তোমার অনুসন্ধানী দৃষ্টিটা ওদের ওপরেই ফেলেছ, তাই নয় কি!
কতকটা তাই–
.
১৯.
কিরীটী মৃদু হাসল, তারপর হাতের চুরুটে একটা টান দিয়ে বললে, সুদর্শন।
বলুন দাদা?
কথামালার একচক্ষু হরিণের গল্পটা তোমার মনে আছে? সেই যে—যে দিকটা সম্পর্কে সে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত ছিল, অবশেষে সেই দিক থেকেই এল মৃত্যুর আঘাত?
আপনি কি বলতে চান দাদা!
এসব ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব করেছ কি পদস্খলন অনিবার্য।
বুঝতে পারলাম না ঠিক দাদা আপনার কথা!
বলছি শ্রীমতী সাবিত্রী দেবীর কথা—
সহসা সুদর্শনের চোখ-মুখ যেন লাল হয়ে ওঠে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, মেয়েটি সত্যিই ভাল, আর মাধবীর আকস্মিক মৃত্যুতে এমন অসহায় হয়ে পড়েছে–
কিরীটী সুদর্শনের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু মদু হাসে।
ওকে দেখলে আপনারও সিমপ্যাথি হবে–
তা হয়ত হবে—যখন তোমার ইতিপূর্বেই হয়েছে। তবে কি জান—
কি?
ক্ষেত্রবিশেষে সিমপ্যাথি ব্যাপারটা যেমন প্রশংসনীয় ও একান্ত প্রয়োজনীয়, তেমনি ক্ষেত্রবিশেষেই আবার হয় মারাত্মক। যাক, আজ আমি এবার উঠব। রাত অনেক হল।
কিন্তু দাদা, আপনি তো কিছুই বললেন না?
বলব, বলব।
কখন?
দুটো দিন ব্যাপারটা আমায় একটু ধীরে-সুস্থে ভাবতে দাও।
কিন্তু–
কিরীটী ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। বললে, আজ বুধবার, সামনের শনিবার এই সময় আসব।
আসবেন আবার?
হ্যাঁ, ইয়ার্ডটা রাতের অন্ধকারে একবার ঘুরে দেখা প্রয়োজন।