কফি-চা করবেটা কে? আগন্তক মৃদু হেসে বলে, এখন তো বিয়েই করলে না—
একটা ভাল কমবাইন্ড হ্যান্ড পেয়েছি, জানেন দাদা!
তাই নাকি?
হ্যাঁ, শ্রীমান গোবর্ধন। বলতে বলতে হাসে সুদর্শন।
নামটি তো বেশ। তা পেলে কোথায় আজকালকার এই ভৃত্যসঙ্কটের দিনে?
পেয়ে গিয়েছি গুরুকৃপায়।
বল কি? গুরুও একটা পাকড়াও করেছ নাকি ইতিমধ্যেই?
গুরু লাভ তো আমার বহু পূর্বেই হয়ে গিয়েছে দাদা!
তাই বুঝি?,তা সে মহাশয় ব্যক্তিটি কে যে তোমার মত ঘোর নাস্তিক ও অবিশ্বাসীকে কৃপা করল?
কিরীটী রায়।
অ্যাঁ!
হ্যাঁ দাদা, আপনি। মনে মনে একলব্যের মত সেই কিশোরকাল থেকেই গুরু পদে বরণ করেছিলাম আপনাকে।
কিরীটী মৃদু হাস্যে বলে, কিন্তু কেন? হঠাৎ ও দুর্মতি হল কেন?
জানেন দাদা, প্রথমে ছিলেন হিরো-হিরো-ওয়ারশিপ, তারপর হলেন গুরু, পথপ্রদর্শক—বসুন দাদা, গোবর্ধনকে চায়ের কথা বলে আসি।
সুদর্শন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
১৭.
বছর সাতেক আগে এক ট্রেনের কামরায় কিরীটীর সঙ্গে সুদর্শনের আকস্মিক ভাবে প্রথম আলাপ হয়।
কিরীটী ও কৃষ্ণা মুসৌরী যাচ্ছিল ট্রেনে।
সেই ট্রেনেই যাত্রী ছিল সুদর্শন। সে তখন সবে বি.এস-সি পাস করে যা হোক। কিছু একটা চাকরির ধান্দায় ঘুরছে।
কাগজে বহুবার কিরীটীর ফটো ইতিপূর্বে দেখেছিল সুদর্শন এবং তাহার রহস্য উদ্ধারের অনেক অত্যাশ্চর্য কীর্তি-কাহিনী পড়ে পড়ে তার এক অন্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছিল।
একটা বড় জংশন স্টেশনে গাড়ি তখন থেমেছে। সবে ভোর হয়েছে। প্ল্যাটফর্মে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ ফার্স্ট ক্লাস কামরার জানলার ধারে উপবিষ্ট কিরীটীকে দেখতে পায় সুদর্শন।
চমকে ওঠে সুদর্শন। কি আশ্চর্য, কিরীটী রায়!
গাড়ি চলতেই সুদর্শন লাফিয়ে সেই ফার্স্ট ক্লাস কামরাতে উঠে পড়ে। তারপর বলে, আমার কিন্তু স্যার ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট নয়–থার্ড ক্লাসের–
তবে এ গাড়িতে উঠলে কেন? কিরীটী শুধিয়েছিল।
আপনাকে এই জায়গায় দেখে আপনার সঙ্গে আলাপ করবার লোভটা সামলাতে পারলাম না। তাতে যদি ফাইন দিতে হয় তো দেব।
তুমি আমাকে চেনো?
না চিনলে উঠেছি?
সুদর্শনের গন্তব্যস্থল ছিল হরিদ্বার—তার পিসেমশাইয়ের ওখানে। কিন্তু যে-যাত্রায় সে কিরীটীর সঙ্গে আলাপ হবার পর বেমালুম হরিদ্বারের কথা ভুলে গিয়ে সোজা তাদের সঙ্গে মুসৌরী চলে গিয়েছিল। তারপরই ঘনিষ্ঠতা।
কিরীটীই তার পরিচিত পুলিস-কমিশনারকে ধরে পরে সুদর্শনের চাকরি করে দিয়েছিল।
.
একটু পরে সুদর্শনের পিছনে-পিছনে চা নিয়ে এল গোবর্ধন ট্রেতে করে।
চা পান করতে করতে সুদর্শন একসময় বলে, ভগবান বোধহয় আপনাকে আজ হঠাৎ এভাবে আমার মুশকিল-আসানের জন্যেই পাঠিয়েছেন দাদা।
তোমার আবার মুশকিলটা কি হল সুদর্শন। কিরীটী মৃদু হেসে শুধায়।
বিশ্রী একটা হত্যা-মামলা—
হত্যা মামলা?
হ্যাঁ, দাদা। কদিন ধরে যত ভাবছি ততই যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, দাদা। মনে মনে বোধ হয় তাই আপনাকেই খুঁজছিলাম-ডাকছিলাম—
তোমার রহস্যের কথা শুনব, তার আগে আমার কিছু সংবাদ চাই।
কীসের সংবাদ দাদা?
জান তো, তোমার এই থানা এলাকাতেই অল্প দূরে রেলওয়ে ইয়ার্ডটা আছে—মানে হাওড়ার রেলওয়ে ইয়ার্ড–
হ্যাঁ, জানি তো–আমারই এলাকা।
গত কয়েক বছর ধরে ওয়াগন থেকে হাজার হাজার টাকার মাল চুরি যাচ্ছে। বিশেষ করে ধুতি-শাড়ির পেটি, কেরোসিন, সরষের তেলের ও ঘিয়ের টিন আর দামী দামী ওষুধপত্রের বড় বড় প্যাকিং। অথচ রেল পুলিস আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যাপারটার কোন কিনারা করতে পারেনি–
জানি, সব জানি। এখানে পোস্টিংয়ের সময় বড়কর্তা আমায় সব বলেছিলেন, যদিও আমি কিন্তু দাদা চেষ্টা করে আজ পর্যন্ত কিছু ধরতে পারিনি।
সেই ব্যাপারটারই একটা হদিস খুঁজে বের করবার ভার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে আমার কাধে গত মাসে চাপানো হয়েছে।
সত্যি!
হ্যাঁ। তাই এই তল্লাটের একটা খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানলাম, এই থানায় তুমি কিছুদিন হল এসেছ ইনচার্জ হয়ে। ভাবলাম তোমার সঙ্গেই তাহলে সর্বাগ্রে একবার দেখা করা প্রয়োজন।
তাই এসেছেন?
তাই।
ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে রীতিমত রহস্যজনক দাদা, কারণ আমার আগে চারজন থানা অফিসারকে এক বছর দেড় বছরের মধ্যেই বদলি করা হয়েছে তাদের অপটুতার জন্যে। যদিও আমার ধারণা–
কি?
আমার পূর্বতন অফিসারদের ওই ব্যাপারে কিছুটা ইচ্ছাকৃত অবহেলাছিল।
কেমন করে বুঝলে?
অবিশ্যি তারা হয়ত প্রাণের ভয়েই চুপচাপ থেকেছে বা এড়িয়ে গেছে। ব্যাপারটা–
প্রাণের ভয় ছিল কিনা জানি না, তবে একটা সংবাদ ওই চারজন অফিসার সম্পর্কেই আমি যোগাড় করেছি ইতিমধ্যে।
কি সংবাদ পেয়েছেন?
দুজন তাদের মধ্যে কলকাতার বাইরে জমিজমা কিনেছে, মেয়ের বিয়ে দিয়েছে খরচপাতি করে ভাল ঘরে, আর একজন জমি কিনেছে ও একজন বাড়ি করছে–
বলেন কি দাদা! তার মানে–
তার মানে ঠিক যা স্বাভাবিক তাই। তাদের পরোক্ষ প্রশ্রয় ছিল ওই ব্যাপারে। হয়ত প্রাণের ভয়টাও ছিল, একটু আগে তুমি যা বলছিলে—
.
১৮.
সুদর্শন অতঃপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। তারপর বলে, জানি না দাদা তারা কতটুকু জানতে পেরেছিল। তবে আমি এই চার মাসে নির্ভরযোগ্য তেমন কিছুই জানতে পারিনি। অবিশ্যি না জানতে পারলেও একটা কথা আমার মনে হয়—