তাই নাকি?
হ্যাঁ। বড়বাবু আমাদের সুখের লোটন পায়রা। অত ঝামেলা তার সইবে কেন? তাই আমিও বলে দিয়েছি
কি বলে দিয়েছেন?
যেদিন খুশি যেখানে খুশি তার সে যেতে পারে।
১৬-২০. সুদর্শন একটু থেমে বললে
১৬.
সুদর্শন একটু থেমে বললে, তা সংসারে তো আপনাদের লোক কম নয়! একা একা চালাতে পারবেন?
যেমন করে তোক চালাব—চালাতেই তো হবে।
আচ্ছা শুনেছি সাবিত্রী দেবীর পড়ার খরচ মাধবী দেবীই দিতেন?
হ্যাঁ।
এখন আপনার বোন সাবিত্রীর পড়ার কি হবে?
ও বলছিল ছেড়ে দেবে। পরীক্ষা আর দেবে না। তা আমি বলে দিয়েছি, পরীক্ষা শালা দিতেই হবে। বি. এ. পাস তাকে করতেই হবে। বাবার খুব দুঃখ, তার একটা ছেলেমেয়েও বি. এ. পাস করল না।
কেন, মাধবী দেবী?
মাধবীটা কোনমতে থার্ড ডিভিসনে আই. এ. পাস করেছিল। তারপরই তো ঢুকে গেল চাকরিতে—আর সঙ্গে সঙ্গে অভিনয় করতে শুরু করে দিল।
আপনার বাবা মাধবী দেবীর অভিনয় করার ব্যাপারটা জানাতেন?
না। তিনি কোনদিনই জানতে পারেন নি। তারপর একটু থেমে অমলেন্দু বললে, বাবার ইচ্ছা ছিল ও চাকরি করতে করতেই বি. এ. পরীক্ষাটা দেয়, কিন্তু ওই বয়সে কাচা পয়সা হাতে এলে যা হয়—গেল মাথাটা বিগড়ে।
কেন, বিগড়ে গেল বলছেন কেন?
তাছাড়া কি! যা খুশি তাই তো করে বেড়াচ্ছিল।
যা খুশি তাই করছিলেন মাধবী দেবী? প্রশ্নটা করে তাকাল সুদর্শন অমলেন্দুর মুখের দিকে।
নয় তো কি! সেই কোন সকালে বের হয়ে যেত, তারপর রাত বারোটা সাড়ে বারোটার আগে কোনদিনই তো বাড়িতে ফিরত না।
থিয়েটার করত তো-হয়তো থিয়েটারের রিহার্সালে আটকা পড়ত।
হ্যাঁ, রিহার্সালই বটে। যাক গে, ওসব কথায় আর কাজ কি! কতদিন বলেছি, মাধু, এত রাত করে ফিরিস না, বয়সের মেয়েছেলে তুই, কখন একটা বিপদ-আপদ ঘটাবি। শেষ পর্যন্ত তাই ঘটল। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায় অমলেন্দু, কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
তারপর কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই বলে, কি যে হল—
সুদর্শন দেখতে পায়, অমলেন্দুর চোখের কোল দুটো যেন ছলছল করছে।
অমলেন্দুবাবু!
বলুন স্যার?
আপনার বোনের হত্যার ব্যাপারে কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?
সন্দেহ।
হ্যাঁ। মানে পল্লীর কাউকে—বাইরের কাউকে?
না না, পল্লীর কেউ তা করতে যাবে কেন? কত ছোট থেকে ওকে সবাই দেখে এসেছে–
কিন্তু আমি খবর পেয়েছি–
কি খবর পেয়েছেন?
অনেকেরই ওর ওপরে দৃষ্টি ছিল। এমন কি বিয়েও করতে চেয়েছিল মাধবীকে কেউ কেউ। প্রত্যাখ্যানের সেই আক্রোশে হয়ত–
এসব কথা আপনি কার কাছে শুনলেন?
শুনেছি। বিশেষ করে ওই হীরু সাহা—
মনে হচ্ছে, বড়বাবুই আপনাকে হয়ত ওই সব বলেছে!
তিনি তো বলেছেনই, আপনাদের পল্লীরই আরও দু-একজনের মুখেও শুনেছি।
অমলেন্দুকে যেন সহসা কেমন একটু বিব্রত বোধ হয়। একটু চুপ করে থেকে বললে, কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। কিন্তু তাই বলে সেই আক্রোশে–না না—
তাহলে আপনার কারও ওপর সন্দেহ হয় না?
না।
আরও কিছুক্ষণ এটা-ওটা কথাবার্তার পর অমলেন্দুকে ছেড়ে দিল সুদর্শন।
নাঃ, সমস্ত ব্যাপারটা যেন ক্রমশ বেশ জটিল হয়ে উঠছে!
সুদর্শন যেন কোন কূল-কিনারাই দেখতে পাচ্ছে না।
.
আরও দশ-বারো দিন কেটে গেল ঐ ঘটনার পরে।
মাধবীর আকস্মিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দশের পল্লী ও তার আশপাশে যে কৌতূহলের চাঞ্চল্য জেগেছিল, ধীরে ধীরে ক্রমশ সেটা যেন কেমন থিতিয়ে আসে।
পল্লীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আবার পূর্বের মতই চলতে শুরু করল, কিন্তু সুদর্শন মল্লিকের মনে যেন শান্তি নাই।
মাধবীর মৃত্যুটা যেন তাকে রীতিমত বোকা বানিয়ে দিয়েছে।
নানাজনকে সন্দেহ করেছে, নানা দিক দিয়ে ব্যাপারটা চিন্তা করবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোথায়ও কিছু যেন দানা বেঁধে ওঠেনি। অথচ তার দৃঢ় বিশ্বাস মাধবীর হত্যাকারী বাইরের কেউই নয়—ঐ পল্লীরই কেউ। কিন্তু কে?
ঠিক এমনি সময় একদিন বিকেলের দিকে একটা কালো রঙের ফিয়াট গাড়ি থানার সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ি চালাচ্ছিল লম্বা রোগা এক শ্বেতশুভ্র দাড়ি ও মাথায় পাগড়ি পাঞ্জাবী ড্রাইভার।
গাড়িটা থানার সামনে এসে দাঁড়াবার পর ড্রাইভার হীরা সিং গাড়ির দরজা খুলে দিল।
পরনে পায়জামা ও গরমের পাঞ্জাবি ও তার উপরে দামী একটা শাল জড়ানো, চোখে মোটা কালো সেলুলয়েডের চশমা, মুখে চুরুট, প্রায় ছফুটের কাছাকাছি লম্বা সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নামল।
থানার প্রহরাধীন সেপাইকে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করে, ও. সি. সাহেব আছেন?
জী হাঁ। যাইয়ে না, অফিস-কামরামেই সাব বৈঠা হ্যায়।
আগন্তুক এগিয়ে গেল অফিস কামরার দিকে। দরজা খোলাই ছিল।
আগন্তুকের খোলা দরজাপথে নজরে পড়ল, ও. সি. সুদর্শন মল্লিক গভীর মনোযোগের সঙ্গে সামনে টেবিলের ওপরে একটা মোটা ফাইল নিয়ে কি সব দেখছে।
আগন্তুক ভিতরে পা দিল, সুদর্শন!
চমকে মুখ তুলল সুদর্শন মল্লিক। তারপরই আগন্তুকের দিকে তাকিয়েই সোল্লাসে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, দাদা, আপনি! আসুন আসুন, বসুন-বসুন এই চেয়ারটায়।
সুদর্শন নিজের চেয়ারটাতেই আগন্তুককে বসবার জন্য অনুরোধ জানায়।
পাগল নাকি! ওটা হচ্ছে ও. সি.-র চেয়ার। আমি এই যে বসছি।
আগন্তুক বসল।
সুদর্শন যে কি করবে ভেবে পায় না। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, উঃ, সত্যি দাদা, আমি ভাবতেই পারছি না আপনি আমার এখানে আসবেন! দাদা, কি খাবেন বলুন? চা, না কফি?