সুদর্শন কোন জবাব দেয় না। সে যেন অন্যমনস্কভাবে তখন কি ভাবছিল।
হীরু সাহা বের হয়ে যায় থানার অফিসঘর থেকে।
.
১৫.
হীরু সাহার পর সুদর্শন খগেন পাঠক ও কল্যাণ বসুকেও ডেকে পাঠিয়েছিল থানায়।
তাদের দুজনের কারও কাছ থেকেই বিশেষ কোন সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেনি সুদর্শন।
কল্যাণ বসু ওই দিন রাত্রে অর্থাৎ গত উনিশে শনিবার ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে আগের দিন থেকেই শয্যায় শুয়েছিল।
আর খগেন পাঠক নাকি ওই দিন রাত্রে ঘুমিয়েছিল। সে সত্য বলছে কি মিথ্যা বলছে, বাড়ির লোকদের জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে।
তাছাড়া কল্যাণ বসু লোকটার সরু পাকাটির মত যেরকম চেহারা, তাতে করে মাধবীর মত স্বাস্থ্যবতী ও পূর্ণযৌবনা একটি মেয়েকে গলা টিপে হত্যা করাটা অত সহজ নয়। অতএব ওদের দুজনের ওপরই সন্দেহটা সুদর্শনের তেমন জোরাল হয় না।
ঐদিনই বিকেলের দিকে এল অমলেন্দু, মাধবীর ছোড়দা।
অমলেন্দু প্রথমটায় আসতে চায়নি—আসেওনি। কিন্তু সাবিত্রী যখন বললে, ছোড়দা, থানার দারোগা ডেকে পাঠিয়েছেন-একবার ঘুরে আসতে ক্ষতি কি, অমলেন্দু কি জানি কেন আর আপত্তি জানায়নি।
কি একটা ছুটির দিন যেন ছিল ওই দিনটা। তাছাড়া অফ-ডিউটিও ছিল তার।
মাধবীর হত্যা-রহস্যের ব্যাপারটাই বিকেলের দিকে থানা-অফিসঘরে একা বসে বসে ভালছিল সুদর্শন, এমন সময় অমলেন্দু এল।
সে ঘরে ঢুকেই নিজে থেকেই বলল, আমার নাম অমলেন্দু ব্যানার্জি-মাধবীর ছোড়দা আমি। আমাকে আপনি ডেকেছেন শুনলাম।
বসুন, বসুন।
অমলেন্দু বিনাদ্বিধায় একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল।
অমলেন্দুর চেহারাটা খুব রোগা নয়, আবার মোটাও নয়-মাঝামাঝি। চোখের কোণে কালি, ভাঙা চোয়াল-দেখলেই মনে হয় দেহের ওপর রীতিমত অত্যাচার করে লোকটা। পরনে একটা পায়জামা ও একটা পাঞ্জাবি, তার ওপরে একটা আলোয়ান জড়ানো।
আপনিই তাহলে সাবিত্রী দেবীর ছোড়দা? সুদর্শন বললে।
হ্যাঁ, বললাম তো!
আচ্ছা, গত উনিশে শনিবার সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন?
আমি ও সময়টা কৃষ্ণনগরে একদল বরযাত্রী নিয়ে বাস চালিয়ে গিয়েছিলাম।
ঠিক বলছেন?
কেন, বেঠিক বলব কেন?
কিন্তু আমি যে খবর পেয়েছি অন্যরকম।
কী খবর পেয়েছেন, জানতে পারি কি?
আপনি সন্ধ্যে থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত যাত্রার রিহার্সাল দিয়েছেন!
বাজে কথা! একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা!
বলছেন মিথ্যে কথা?
আলবৎ। কিন্তু কোন্ শালা অমন মিথ্যে কথাটা বলেছে, বলুন তো?
তা জেনে আপনার কি হবে? আপনি বলছেন রিহার্সাল দেননি, ফুরিয়ে গেল! তবে এটা যদি প্রমাণিত হয় পরে যে আপনি রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত রিহার্সাল-রুমে রিহার্সাল দিয়েছেন, ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে দাঁড়াতে পারে এই আর কি!
মানে?
মানে সেই রাত্রেই কিছু পরে আপনার বোন মাধবীকে হত্যা করা হয়েছিল কিনা!
কি বলছেন স্যার? আপনি কি শেষ পর্যন্ত তাহলে আমাকেই আমার বোনের হত্যাকারী বলে ঠাওরালেন নাকি?
সে-রাত্রে ওই সময়টা—মানে রাত দশটা থেকে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত আপনার মুভমেন্ট সম্পর্কে যদি সঠিক প্রমাণাদি না দিতে পারেন, পুলিস আপনাকেও সন্দেহ করবে বৈকি।
বাঃ, মশাই, বেশ! চমৎকার বুদ্ধি! ভাই হয়ে আমি আমার বোনকে খুন করব।
তা প্রয়োজনে ও স্বার্থে ভাই বোনকে, বোন ভাইকে, স্বামী স্ত্রীকে ও স্ত্রী স্বামীকেও খুন অনেক সময় করে বৈকি!
হঠাৎ যেন অমলেন্দু কেমন বোবা হয়ে যায়। তারপর একসময় ধীরে ধীরে বলে,, না, স্যার, আপনি বিশ্বাস করুন, আমি তাকে সত্যিই খুব ভালবাসতাম। ব্যাপারটা শোনা অবধি কেবলই ভাবছি, কে তাকে খুন করতে পারে। যে-ই তাকে খুন করুক, যেমন করে হোক, তাকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে।
তাহলে বলছেন না কেন, ওই সময়টা সে-রাত্রে আপনি কোথায় ছিলেন? কারণ আমি জানি, আপনি আদৌ কৃষ্ণনগরে সে-রাত্রে বাস নিয়ে যাননি—যদিও সবাই তাই জানে, আপনিও সবাইকে তাই বলেছেন।
অমলেন্দু, সুদর্শনের শেষের কথায় হঠাৎ কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে যায় আবার।
কি, তাই সত্যি নয় কি? আপনি যাননি সে-রাত্রে বাস নিয়ে কৃষ্ণনগরে?
না, যাইনি।
তবে রাত সাড়ে দশটায় রিহার্সাল ক্লাব থেকে উঠে কোথায় গিয়েছিলেন? আর তার পরের দুটো দিন কোথায়ই বা ছিলেন রাত এগারোটা পর্যন্ত?
একটা বিশেষ কাজে আমাকে এক জায়গায় যেতে হয়েছিল।
কি কাজ? কোথায় যেতে হয়েছিল?
বলতে পারব না আমি।
বলবেন না!
বললাম তো বলতে পারব না।
হুঁ। আচ্ছা, বাসের ড্রাইভারি করে আপনি কত পান?
মাইনে ও উপরি-মানে ওভারটাইম নিয়ে শতিনেক মত পাই।
তবু আপনি সংসারে কিছু তো দিতেনই না, এমন কি মধ্যে মধ্যে আবার মাধবী দেবীর কাছ থেকেও টাকা নিতেন, সত্যি কিনা?
নিতাম। তা এত খবর পেলেন কোথায়?
যেখানেই হোক পেয়েছি, কিন্তু এখন বলুন তো, একা মানুষের অত টাকার আপনার কি এমন প্রয়োজন হত?
একটু-আধটু ড্রিঙ্ক করি আমি–
তাও আমি জানি। তা এখন কি করবেন? মাধবী দেবীই তো শুনেছি এতদিন আপনাদের সংসারটা চালাতেন!
কি আর করব—ও শালার মদটাই হয়ত শেষ-বেশ ছেড়ে দিতে হবে দেখছি।
পারবেন?
বোধ হয় পারব না। তবু চেষ্টা তো করতে হবে। কারণ বড়বাবু এর মধ্যেই নোটিশ দিয়ে দিয়েছেন, বাড়িতে আর তিনি থাকবেন না, মিলের কোয়ার্টারে চলে যাবেন।