আমাদেরই দলের একজনের লেখা।
কে তিনি? আপনাদের দশের পল্লীর একজন কি?
হ্যাঁ, নরহরিদার নিজের লেখা।
বলেন কি, সরকার মশাই তো তাহলে দেখছি গুণী ব্যক্তি। তা উনিও যাত্রার দলের পার্ট করেন নাকি?
না।
কেন?
তাঁর সময় কোথায়?
খুব বিজি মানুষ, তাই না?
হ্যাঁ।
তা সে-রাত্রে রিহার্সালে আর কে কে ছিলেন?
আমরা জনা-চারেক।
মাত্র চারজনকে নিয়ে নতুন নাটকের রিহার্সাল প্রায় সারাটা রাত ধরে হল!
নতুন একটি মেয়ে নেওয়া হয়েছে যাত্রার দলে। সে-ই যাজ্ঞসেনী করবে। তাই মোশন মাস্টার তাকে আর আমাদের তিনজনকে নিয়ে বিশেষভাবে রিহার্সাল দিচ্ছিলেন।
.
১৪.
মোশনমাস্টারটি কে? সুদর্শন জিজ্ঞাসা করে।
অম্বিকাদা।
অম্বিকাদা! কে তিনি? আপনাদেরই দশ নম্বর পল্লীর কেউ?
হ্যাঁ।
তা ভদ্রলোক আর কি কাজকর্ম করেন?
স্টেট বাসের ড্রাইভার।
হুঁ। তা আপনারা তিনজন ছাড়া আর কে কে সেদিন রাত চারটে পর্যন্ত রিহার্সাল দিয়েছিলেন?
আমি, গোকুল খাঁ, আর ছিল অমলেন্দু—
অমলেন্দু, মানে অমলেন্দু ব্যানার্জী-মাধবী ব্যানার্জীর ভাই?
হুঁ।
সে-রাত্রে রাত চারটে পর্যন্ত রিহর্সালে ছিলেন অমলেন্দুবাবু?
না, রাত সাড়ে দশটা নাগাদ সে চলে যায়।
আপনি কখন রিহার্সাল-রুমে গিয়েছিলেন?
রাত সাড়ে নটা নাগাদ–খেয়েদেয়ে।
তাহলে রাত সাড়ে নটা থেকে রাত চারটে পর্যন্ত আপনি রিহার্সাল রুমেই ছিলেন?
তাই ছিলাম।
মধ্যে একবারও বাইরে যাননি?
না।
ঠিক করে মনে করে দেখুন-রাত সাড়ে দশটা থেকে রাত বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে!
না।
যাননি যে প্রমাণ করতে পারবেন তো?
পারব। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো?
মানে আপনাদের যার যার সঙ্গে মাধবী দেবীর পল্লীতে একটু ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাদের সে-রাত্রের গতিবিধি সম্পর্কে আমার জানা প্রয়োজন, তাই-
আমার সঙ্গে মাধবীর ঘনিষ্ঠতা ছিল, কে আপনাকে বললে?
ও কি আর চাপা থাকে মশাই, প্রেম-ট্রেমের ব্যাপার—
ভুল করেছেন তাহলে আপনি।
ভুল করেছি?
হ্যাঁ, রীতিমত ভুল। কারণ মাধবীর সঙ্গে আমার যাকে বলে ঝগড়াই ছিল। মুখদেখাদেখিও ছিল না ইদানীং।
ঝগড়ার কারণটা কি—প্রত্যাখ্যান?
আজ্ঞে না।
তবে?
সে আপনার শুনে কি হবে!
তবু না হয় শুনলাম।
বলতে আমি বাধ্য নই।
তাহলে আপনারই ক্ষতি—
মানে?
মানে তো সহজ। পুলিশ আপনাকেও মাধবীর হত্যাকারী হিসাবে সাসপেক্টসদের দলেই ফেলবে।
তার মানে বলতে চান আমি মাধবীকে হত্যা করেছি?
সেরকম ভাবাটা কি খুব অন্যায় কিছু? আপনিই বলুন না?
হঠাৎ যেন হীরু সাহা স্তব্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। সুদর্শনের মুখের দিকে। তারপর বলে, আপনি তাই বিশ্বাস করেন নাকি?
খানিকটা সন্দেহ থেকে যাচ্ছে বৈকি!
কেন?
সে-রাত্রে আপনার গতিবিধি সম্পূর্ণ না জানা পর্যন্ত সন্দেহের তালিকা থেকে তো আপনাকে বাদ দেওয়া যাবে না।
কিছুক্ষণ আবার হীরু সাহা চুপ করে থাকে। কি যেন ভাবে, তারপর বলে, আপনি বিশ্বাস না করলে কি করতে পারি বলুন! তবে জানবেন মাধবীকে আমি হত্যা করিনি।
হত্যা করেছেন–তা কি বলেছি হীরুবাবু? তাছাড়া–
সুদর্শন কথাটা শেষ করে না, হীরু সাহার মুখের দিকে তাকায়। হীরু সাহাও ওই সময় তার মুখের দিকে তাকায়।
তাছাড়া কি? হীরু সাহা মিনমিনে গলায় যেন প্রশ্নটা করে এবারে।
আমি জানি, আপনি মাধবীকে ভালবাসতেন!
কে-কে বললে?
হ্যাঁ, তাকে আপনি বিয়েও করতে চেয়েছিলেন; এবং প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন ইদানীং।
না।
নয়?
না, আপনি মিথ্যা খবর পেয়েছেন।
মিথ্যে খবর?
হ্যাঁ। ওর মত একটা সামান্য মেয়েকে ভালবাসতে যাব আমি কোন্ দুঃখে!
দুঃখে তো মানুষ ভালবাসে না, ভালবাসাটা আনন্দেরই প্রকাশ। যাক গে সে কথা, এবার বলুন তো, মাধবীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল আপনার কি নিয়ে?
সে সম্পূর্ণ আমার পার্সোনাল অ্যাফেয়ার!
সেটাও তাহলে বলবেন না?
বলবার কিছু নেই।
হুঁ। আচ্ছা, ওর দাদা অবিনাশবাবুর সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই হৃদ্যতা আছে?
ওটা তো একটা ছুঁচো। আই হেট হিম!
হুঁ। হীরুবাবু, কতদূর আপনি লেখাপড়া করেছেন? না সেটাও বলতে আপনার আপত্তি আছে?
আমি স্কুল-ফাইনাল পাস।
কবে কত বছর আগে পাস করেছেন?
মাধবীর দু বছর আগে।
সুদর্শন মল্লিক হীরু সাহাকে মাধবীর নামোচ্চারণ করতে শুনে মৃদু হাসল।
আচ্ছা, অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে আপনার হৃদ্যতা আছে কি?
অশিক্ষিত একটা বাস-ড্রাইভার, তায় বেহেড মাতাল! ওর সঙ্গে কথা বলতেও ঘৃণা হয়।
আর খগেন পাঠক?
কে, খগনা? ওই মোটর-মেকানিকটা? ওটা তো একটা বুদ্ধু দি গ্রেট নাম্বার ওয়ান!
আর কল্যাণবাবু?
ও তো আমাদের মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের পাণ্ডা। ওকে শ্রদ্ধা করে না এ তল্লাটে কে এমন আছে?
আর সুবোধ মিত্র—আপনাদের দশ নম্বর পল্লীর?
ও আমাদের পল্লীতে থাকে বটে, তবে আমাদের কারও সঙ্গে কখনও মেশেই না। বি. এ. পাস। অফিসে ভাল চাকরি করে। তার উপর আবার চমৎকার বেহালা বাজায়। ওর সঙ্গে আমাদের মত সাধারণ লোকের বন্ধুত্ব হবে, তাহলেই হয়েছে।
আচ্ছা, নরহরি সরকার লোকটা কেমন?
কেন বলুন তো! নরহরিদার ওপরেও আপনার সন্দেহ হয় নাকি?
ছি ছি, কি যে বলেন। সাত্ত্বিক, বৈষ্ণব মানুষ, ওঁকে সন্দেহ করব কি? এমনি জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম।
তা এবারে আমি যেতে পারি?
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। যাবেন বৈকি।
তাহলে চললাম। নমস্কার।