দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিল।
সাবিত্রী আবার মাথায় গুণ্ঠন তুলে দিয়ে আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল।
খুব শীত পড়েছে। সুদর্শন হাঁটতে হাঁটতে একসময় বলে।
সাবিত্রী সুদর্শনের কথার কোন জবাব দেয় না।
আচ্ছা সাবিত্রী–
হঠাৎ যে কেন সুদর্শন সাবিত্রীকে তুমি বলে সম্বোধন করে, নিজেও বুঝি বুঝতে পারে না।
বলুন?
তোমার দিদির কোন শত্রু ছিল বলে তোমার মনে হয়?
শত্রু?
হ্যাঁ।
না, তেমন তো কোন কিছু শুনিনি। তবে মনে হয় আমার, হীরু সাহার দিদির ওপর একটা আক্রোশ ছিল হয়ত!
কেন? আক্রোশের কারণ ছিল কি?
ছিল—
কি?
দিদিকে হীরু সাহা একসময় বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু দিদি flatly তাকে না করে দিয়েছিল।
তারপর?
সেই ব্যাপার নিয়ে দাদার সঙ্গে শুনেছি হীরু সাহার কথা-কাটাকাটি হয়েছিল।
পল্লীতে আর কারও কোন রকম তার প্রতি আক্রোশ ছিল না?
না। তাছাড়া আগেই তো আপনাকে বলেছি, দিদি অত্যন্ত বেপরোয়া আর দুঃসাহসী ছিল, কেউ আর থাকলেও দিদি কখনও বলেনি সে কথা আমাকে।
তোমার দাদাদের সঙ্গে দিদির সম্পর্ক কেমন ছিল?
দাদা দিদিকে দেখতে পারত না এতটুকু, ঠেস দিয়ে ছাড়া কথাই বলত না কখনও। দিদি অবিশ্যি কখনও কোন জবাব দেয়নি।
আর ছোড়দা?
ছোড়দা একটু বেশি রাগী হলেও দিদির সঙ্গে ভাল ব্যবহারই করত।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। মধ্যে মধ্যে টাকার দরকার হলে দিদির কাছেই যে তাকে হাত পাততে হত!
কেন? সে তো শুনেছি ভালই রোজগার করে!
করলে কি হবে, অত বাবুয়ানী করলে আর মদ খেলে টাকা থাকবে কোথা থেকে!
তোমার ছোড়দা ফিরেছে?
যখন বাড়ি থেকে বের হই তখনও আসেনি—
কাল যেন বাড়িতেই থাকে, আমি না যাওয়া পর্যন্ত—বোলো তাকে।
বেশ, বলব। কিন্তু—
যদি না ফিরে এসে থাকে, তবেই তো। না এলে আর কি করবে!
না, তা নয়—বলছিলাম, আর আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে না। আমি তো বাড়ির কাছে প্রায় এসেই গেছি, এবার একা-একাই আমি বাকি পথটুকু চলে যেতে পারব।
সুদর্শন বুঝতে পারে, সাবিত্রীর ইচ্ছা নয় সে আর তার সঙ্গে যায়।
সুদর্শন দাঁড়িয়ে গেল, বললে, বেশ, যাও।
সাবিত্রী পল্লীর দিকে এগিয়ে গেল। সুদর্শন কিন্তু তারপরও অনেকক্ষণ সেইখানেই পথের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে। সাবিত্রীর চলমান দেহটা ক্রমে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল একসময়।
চারদিকে একটু অদ্ভুত স্তব্ধতা। রাতের আকাশ থেকে নিঃশব্দে যেন শীতের হিম ঝরে পড়ছে। কোথায় যেন একটা কুকুর ডেকে উঠল। ধীরে ধীরে একসময় থানার পথে ফিরল সুদর্শন।
কয়েক পা অগ্রসর হতেই কানে এল একটা ক্ষীণ গানের সুর। কে যেন গান গাইতে গাইতেই পল্লীর দিকে এগিয়ে আসছে। ক্ষীণ হলেও গানের সুর ও কথাগুলি স্পষ্ট শুনতে পায় :
এত জল তোর কাজল চোখে পাষাণী আনলে বল্ কে—
সুদর্শন দাঁড়ায়।
গানের কথাগুলো কিছুটা যেন জড়ানো-জড়ানো। ক্রমশ গানের সুর আরও স্পষ্ট হয়। ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসে।
পরনে লংস ও গায়ে হাওয়াই শার্ট, মাথায় ও গলায় একটা কম্ফটার জড়ানো কে একজন গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে, আবছা-আবছা দেখতে পায় সুদর্শন। এবং প্রায় আসতে আসতে হঠাৎ বোধ হয় সুদর্শনকে দেখতে পেয়েই ওর হাত দুয়েক ব্যবধানে দাঁড়িয়ে পড়ে।
ঝাপসা ঝাপসা চাঁদের আলোয় সুদর্শন দেখতে পায়, লোকটা পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল। প্যাকেটে বোধ হয় একটাই সিগারেট অবশিষ্ট ছিল। সিগারেটটা মুখে দিয়ে পকেট হাতড়ে একটা দেশলাই বের করল। তারপর দুটো কাঠি জ্বালাবার চেষ্টা করল, কিন্তু একটাও জ্বলল না। আর কাঠি অবশিষ্ট ছিল না বোধ হয় দেশলাইয়ের বাক্সে।
বিরক্ত চিত্তে শূন্য দেশলাইয়ের বাক্সটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে দিতে বললে, লে বাবা, ফিনিশ!
হঠাৎ ওইসময় সামনে দণ্ডায়মান সুদর্শনের দিকে নজর পড়ায় ওর দিকে তাকাল এবং বললে, ম্যাচিস আছে নাকি স্যার?
সুদর্শন পকেট থেকে তার দেশলাইটা বের করে কয়েক পা এগিয়ে এসে লোকটির দিকে এগিয়ে ধরল।
.
১২.
লোকটি দেশলাইটা হাতে নিয়ে একটা কাঠি জ্বালিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে দেশলাইটা ফিরিয়ে দিয়ে জড়িত কণ্ঠে বললে, থ্যাঙ্কস!
ক্ষণপূর্বে দেশলাই-কাঠির আলোতেই লোকটিকে চিনতে পেরেছিল সুদর্শন—সাবিত্রীর ছোড়দা অমলেন্দু।
দেশলাইটা ফিরিয়ে দিয়ে আর একটি কথাও না বলে সিগারেট টানতে টানতে। অমলেন্দু পল্লীর দিকে এগিয়ে গেল। অমলেন্দুর দেহটা আবছা আলো-অন্ধকারে মিলিয়ে এ যেতেই সুদর্শন আবার থানার দিকে পা বাড়াল।
শীতের হিমঝরা রাত স্তব্ধ, নিঃসঙ্গ। থানার পথে ফিরতে ফিরতেই হঠাৎ কি মনে হয় সুদর্শনের, খানার দিকে না গিয়ে পল্লীর দিকেই চলতে লাগল আবার।
পল্লীর সব বাসিন্দাই ততক্ষণে যে যার ঘরে খিল এঁটে শয্যায় গা ঢেলে দিয়েছে। মাধবীদের গৃহের দিকে কেন জানি চলতে লাগল সুদর্শন। হঠাৎ কানে এল বেহালার একটা মিষ্টি সুর।
পল্লীর মধ্যেই কোথায় কে যেন বেহালা বাজাচ্ছে। সুরটা ভারি মিষ্টি এবং চেনাচেনা মনে হয় সুদর্শনের। সুরটা ধরা পড়ে—বাগেশ্রী। বাগেশ্রী সুরে চমৎকার আলাপ করছে বেহালায়। বেহালায় সেই সুরালাপের আকর্ষণে যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যায় সুদর্শন।
সুবোধ মিত্রের সেই চেনা বাড়িটার সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়ে গেল সুদর্শন। বাইরের দিককার একটা জানলা খোলা। খোলা জানলাপথে আলোর আভাস চোখে পড়ে।