- বইয়ের নামঃ প্রজাপতি রঙ
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১-০৫. আপনি বিশ্বাস না করলে
প্রজাপতি রঙ
০১.
আপনি বিশ্বাস না করলে কি করতে পারি বলুন! তবে জানবেন মাধবীকে আমি হত্যা করিনি।
হত্যা করেছেন তা কি আমি বলেছি হীরুবাবু? সুদর্শন মল্লিক মৃদু হেসে বলে, তা তো আমি বলিনি! তাছাড়া
সুদর্শন মল্লিক ঝানু ও.সি.। যেমন পালোয়ানের মত চেহারা তেমনি দুর্জয় সাহস।
চার-পাঁচজন ও.সি.-কে পর পর বদলি করার পর ডি.সি. নিজে বেছে বেছে তরুণ ও.সি-দের মধ্যে সুদর্শন মল্লিককেই শেষ পর্যন্ত ও তল্লাটের থানার ইনচার্জ করে বসিয়েছিলেন।
পোস্টিং অর্ডারটা দেবার সময় ডি.সি. বলেছিলেন সুদর্শন ইউ আর মাই চয়েস। ওই তল্লাটের দশ নম্বর পল্লীটাই আমি জানি যত রকম ক্রাইমের আড়া। যত রকমের চোরাইকারবার–কাছের রেলওয়ে ইয়ার্ড থেকে ওয়াগন ভেঙে হাজার হাজার টাকার মাল সরানো তো আছেই, সেই সঙ্গে বছরে চার-পাঁচটা খুন হবেই। অথচ আজ পর্যন্ত পুলিস ধরতেই পারল না কে বা কারা ওইভাবে খুন করেছে। আজ তিন বছরে পর পর পাঁচজন অফিসারকে ওখানে পোস্টিং করেছি, but none of them-তাদের মধ্যে কেউই ব্যাপারটার এতটুকু কোন হদিস করতে পারেনি। তাই আমার মনে হয়
কি স্যার?
একটা গ্যাং আছে ওই দশ নম্বর পল্লীর মধ্যে যারা ওই ক্রাইমের মূলে!
সুদর্শন বলেছিল, আমি চেষ্টা করব স্যার।
থানার চার্জ নিয়েই ওখানে এসে সুদর্শন পর পর কদিন দশ নম্বর পল্লীটার মধ্যে গিয়ে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে এসেছিল।
যাদের উপর তার সন্দেহ পড়েছিল, মনে মনে তাদের একটা লিস্টও তৈরি করে ফেলেছিল। এবং ঐ সন্দেহযুক্ত ব্যক্তিদের লিস্ট তৈরি করবার সময়ই হীরু সাহার উপর নজর পড়ে সুদর্শনের।
ব্যায়ামপুষ্ট তাগড়াই চেহারা হীরু সাহার। কাছেই যে জুটমিলগুলো আছে তারই একটায় চাকরি করে। বার-দুই স্কুল-ফাইন্যাল ফেল করে পড়াশুনোয় ইতি দিয়েছিল। বাড়িতে বিধবা মা আর ছোট একটি ভাই। পরনে সর্বক্ষণ টেরিলিনের প্যান্ট ও হাওয়াই শার্ট। মুখে সর্বক্ষণ সিগারেট। পল্লীর সবাই তাকে ভয় করে, সমীহ করে।
আলাপ করবার চেষ্টা করেছিল হীরু সাহার সঙ্গে একদিন সুদর্শন, কিন্তু হীরু সাহা পাত্তা দেয়নি। বলেছিল, অত খবরে আপনার দরকারটা কি স্যার! আমি কি করি, কখন বাড়ি ফিরি, কার কার সঙ্গে আমার দোস্তি—জানবার আপনার প্রয়োজনটা কি জানতে পারি কি?
সুদর্শন মল্লিক মৃদু হেসেছিল, তারপর বলেছিল, আপনাদের পাড়ায় এলাম, আলাপপরিচয় করব না?
বেশি আলাপ ভাল নয় স্যার, বুঝলেন!
কেন বলুন তো?
না, তাই বলছি। কথাটা বলে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল হীরু সাহা।
পাশের বাড়ির খগেন পাঠক বলেছিল, ওকে বেশি ঘাঁটাবেন না স্যার। কখন রাতেবিরেতে চোরাগোপ্তা চালিয়ে দেবে, সঙ্গে সঙ্গে একেবারে সোজা উপরতলার বাসিন্দা হয়ে যাবেন পার্মানেন্টলি! হেঁ-হেঁ, বুঝলেন না?
কথাগুলো বলে রহস্যময় হাসি হেসেছিল খগেন পাঠক।
খগেন পাঠকও ওই হীরু সাহারই সমবয়সী। সে একজন নামকরা মোটর-মেকানিক এবং ঐ পল্লীর বাসিন্দা-সুদর্শনের সন্দেহের তালিকার মধ্যে অন্যতম চিহ্নিত।
আরও একজনের উপর নজর পড়েছিল সুদর্শন মল্লিকের।
মাধবী ব্যানার্জি।
ওই পল্লীতেই থাকে। বাপ পতিতপাবন ব্যানার্জি অন্ধ। পূর্ববঙ্গের কোন এক স্কুলে মাস্টার ছিল। দেশ-বিভাগের ফলে ছিটকে ঘুরতে ঘুরতে ওই পল্লীতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বছরকয়েক আগে।
দুই ছেলে দুই মেয়ে। অবিনাশ-অমলেন্দু দুই ভাই আর দুই বোন মাধবী ও সাবিত্রী। বড় দুই ভাই স্কুলের চৌকাটটা ডিঙিয়েই লেখাপড়া ছেড়ে একজন ঢুকেছিল মিলে, অন্যজন মোটর-ড্রাইভিং শিখে হয়েছিল বাসের ড্রাইভার। দুই ভাইয়ে যা উপার্জন করে তাতে অভাব থাকার কথা নয়, কিন্তু সংসারে তারা বড় একটা উপুড়হস্ত করে না। অগত্যা মাধবীকেই হাল ধরতে হয়েছিল।
আই.এ. পাস করে একটা অফিসে চাকরি নিয়েছিল, ওই সঙ্গে অফিসের ক্লাবে ক্লাবে অভিনয় করত। অভিনয়ে বরাবরই একটা বেশ ন্যাক ছিল মাধবীর। ঐ অভিনয় করবার ক্ষমতার জন্যই অফিসের মাইনের দুগুণ তিনগুণ ইনকাম ছিল। অভিনয় করে নানা অফিস ক্লাবে ক্লাবে বেশ মোটা টাকাই উপার্জন করত মাধবী।
ছোট বোন সাবিত্রী কলেজে বি.এ. পড়ে।
গরিব রিফিউজি স্কুল-মাস্টারের মেয়ে হলে কি হবে, দেখতে দুটি বোনই সুন্দরী। তাহলেও দুজনের সৌন্দর্যের মধ্যে একটা যেন পার্থক্য ছিল।
মাধবীর দেহ ও চোখে-মুখে যেন একটা উগ্র যৌন আকর্ষণ ছিল, যেটা স্বভাবতই পুরুষকে আকর্ষণ করত। উগ্র স্পষ্ট যৌবন। দেহের প্রতিটি অঙ্গ, প্রতিটি ঢেউ যেন সোচ্চার। তার উপরে মাধবীর বেশভূষা, চালচলন, কথাবার্তা ও চোখের চাউনির মধ্যেও সর্বক্ষণ যেন একটা যৌন আবেদন স্পষ্ট হয়ে উঠত। তাই পল্লীতে অনেকেই বলাবলি করত ওর ইনকাম দেখে, কেবল চাকরি আর অভিনয়ই নয়—অন্যভাবেও উপার্জন হয় ওর।
অথচ ছোট বোন সাবিত্রী একেবারে তার বড় বোনের যেন সম্পূর্ণ বিপরীত। শান্ত নম্র। ধীর গম্ভীর।
পল্লীর সকলের সঙ্গেই ছিল মাধবীর আলাপ! পল্লীর সব যুবকেরই দৃষ্টি যে মাধবীকে সর্বক্ষণ ঘিরে ছিল, তাও জেনেছিল সুদর্শন মল্লিক। কিন্তু মাধবীর যে কারও প্রতি কোন বিশেষ পক্ষপাত আছে সে-সম্পর্কে কোন সংবাদই পায়নি সুদর্শন।