পুরন্দর চৌধুরী!
সঙ্গে সঙ্গেই যেন নতুন করে আবার পুরন্দর চৌধুরীর চিন্তাটা মনের মধ্যে জেগে ওঠে ইন্সপেক্টারের। লোকটার বুদ্ধি তী, ধূর্ত, সতর্ক এবং প্রচণ্ড সুবিধাবাদী ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ।
প্রথম দিকে ভদ্রলোক একেবারেই মুখ খোলেননি বা খুলতে চাননি।
অতর্কিতে ল্যাবরেটরী ঘরে রাত্রির অভিসারে ধরা পড়ে গিয়েই তবে মুখ খুলেছেন। এবং শুধু মুখ খোলাই নয়, বিচিত্র এক কাহিনীও শুনিয়েছেন।
লোকটা কিন্তু তথাপি এত সহজ বা সরল মনে হচ্ছে না ইন্সপেক্টারের।
সহসা এমন সময় ইন্সপেক্টারের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল সিঁড়িতে একটা দ্রুত স্খলিত পদশব্দ শুনে। কে যেন সিঁড়িপথে উঠে আসছে।
ফিরে তাকালেন ইন্সপেক্টার সিঁড়ির দিকে।
.
১৯.
যে ব্যক্তিটি সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভোরের আলোয় তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল সে আর কেউ নয় ঐ বাড়ির একজন ভৃত্য রেবতী।
রেবতীর চোখে মুখে একটা স্পষ্ট ব্যস্ততা ও আতঙ্ক।
রেবতীই কথা বললে প্রথমে উত্তেজিত কণ্ঠে, ইন্সপেক্টার সাহেব, রামচরণ বোধ হয় মারা গেছে।
কথাটা শুনেই মিঃ বসাক রীতিমত যেন চমকে ওঠেন। তাঁর বিস্মিত কষ্ঠ হতে আপনা হতেই যে কথাগুলো বের হয়ে এল, মারা গেছে রামচরণ! সে কি!
হ্যাঁ। আপনি একবার শীগগিরই নীচে চলুন।
চল্ তো দেখি।
কোনরূপ সময়ক্ষেপ না করে রেবতীর পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন ইন্সপেক্টার। একতলার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের শেষ ঘরটির দরজাটা তখনও খোলাই ছিল।
রেবতীই প্রথমে গিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল খোলা দরজাপথে।
মিঃ বসাক তার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকলেন।
ঘরের আলোটা তখনও জ্বলছে। যদিও পশ্চাতের বাগানের দিককার খোলা জানলাপথে ভোরের পর্যাপ্ত আলো ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে।
ভোরের সেই স্পষ্ট আলোয় যে দৃশ্যটি ইন্সপেক্টারের চোখে পড়ল ঘরে প্রবেশ করেই, তা যেমন বীভৎস তেমনি করুণ।
জানলার প্রায় লাগোয়া একটা চৌকির উপরে রামচরণের দেহটা চিত হয়ে পড়ে আছে।
মুখটা দরজার দিকেও একটু কাত হয়ে আছে।
চোখের পাতা খোলা, চোখের মণি দুটো যেন ঠেলে বের হয়ে এসেছে।
মুখটা ঈষৎ হাঁ হয়ে আছে। এবং সেই দ্বিধাবিভক্ত, হাঁ করা ওষ্ঠের প্রান্ত বেয়ে নেমে এসেছে লালামিশ্রিত ক্ষীণ একটা রক্তের ধারা।
সমস্ত মুখখানা যেন নীল হয়ে আছে। খালি গা, পরিধানে একটি পরিষ্কার ধুতি, প্রসারিত দুটি বাহুশয্যার উপরে মুষ্টিবদ্ধ।
প্রথম দর্শনেই বোঝা যায় সে দেহে প্রাণ নেই।
কয়েকটা মুহূর্ত সেই বীভৎস দৃশ্যের সামনে নির্বাক স্থাণুর মতই দাঁড়িয়ে রইলেন মিঃ বসাক।
এ যেন সেই গতকাল সকালের বীভৎস করুণ দৃশ্যেরই হুবহু পুনরাবৃত্তি।
আশ্চর্য, চবিবশ ঘণ্টাও গেল না প্রথম বাড়ির মালিক তারপর বাড়ির পুরাতন ভৃত্য সম্ভবতঃ একইভাবে নিষ্ঠুর হত্যার কবলিত হল।
কে জানত গতকাল রাত্রে এগারোটার সময় সকলকে খাইয়ে দাইয়ে যে লোকটা সকলের শয়নের ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দিয়ে বিদায় নিয়ে এসেছিল তার মৃত্যু এত নিকটে ঘনিয়ে এসেছে!
কে জানত মৃত্যু তার একেবারে ঠিক পশ্চাতে এসে মুখব্যাদন করে দাঁড়িয়েছে। প্রসারিত করেছে তার করাল বাহ!
আকস্মিক ঘটনা পরিস্থিতির বিহ্বলতাটা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টার তাঁর প্রায় পাশেই দণ্ডায়মান রেবতীর দিকে।
রেবতী, কখন তুমি জানতে পেরেছ এই ব্যাপারটা?
সকালে উঠেই এ ঘরে ঢুকে।
সকালে উঠেই এ ঘরে এসেছিলে কেন?
উনুনে আগুন দিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করব কিনা জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম।
ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল?
হ্যাঁ। তবে কপাট দুটো ভেজানো ছিল।
রামচরণ কি সাধারণত ঘরের দরজা খুলেই শুত রেবতী?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তুমি কোন্ ঘরে থাক?
ঠিক এর পাশের ঘরটাতেই।
কাল রাত্রে শেষ কখন তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল রামচরণের, রেবতী।
কত রাত তখন ঠিক আমি বলতে পারব না, আপনাদের খাওয়াদাওয়ার পরই রামচরণ রান্নাঘরে আসে, আমি তখন রান্নাঘর পরিষ্কার করছিলাম। আমাকে ডেকে বললে, তার শরীরটা নাকি তেমন ভাল নয়, আর ক্ষুধাও নেই, সে শুতে যাচ্ছে।
বলেছিল তার শরীরটা ভাল নয়?
হ্যাঁ। অবিশ্যি কথাটা শুনে আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম সাহেব।
কেন বল তো?
তা আজ্ঞে আজ পাঁচ বছর হল এ বাড়িতে আমি আছি, কখনও তো রামচরণকে অসুস্থ হতে দেখিনি। তবে কাল রাত্রে বোধ হয়—
কথাটা সম্পূর্ণ শেষ না করে যেন একটু ইতস্তত করেই থেমে গেল রেবতী।
কাল রাত্রে বোধ হয় কী রেবতী? চুপ করলে কেন?
আজ্ঞে, রামচরণ নেশা করত।
নেশা করত? কতকটা যেন চমকিতভাবেই ইন্সপেক্টার প্রশ্নটা করলেন রেবতীকে। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল সিংহলী মুক্তার কথা।
প্রভু ভৃত্য দুজনেই কি তবে মুক্তার নেশায় অভ্যস্ত ছিল নাকি!
কি নেশা করত রামচরণ?
আজ্ঞে, রামচরণ আফিং খেত।
আফিং! কথাটা বলে মিঃ বসাক তাকালেন রেবতীর মুখের দিকে।
আজ্ঞে হ্যাঁ। সন্ধ্যার দিকে তাকে রোজ একটা মটরের দানার মত আফিং খেতে দেখতাম। তবে কাল রাত্রে বোধ হয় তার আফিংয়ের মাত্রাটা একটু বেশীই হয়েছিল আমার মনে হয়।
কি করে বুঝলে?
কাল যেন রামচরণের একটু ঝিমঝিম ভাব দেখেছি।
ইন্সপেক্টর কিছুক্ষণ অতঃপর চুপ করে কি যেন ভাবলেন।
তারপর আবার প্রশ্ন করলেন, তুমি তো পাশের ঘরেই ছিলে রেবতী, রাত্রে কোনরকম শব্দ বা গোলমাল কিছু শুনেছ?