আপনি যা সন্দেহ করছেন বিনয়েন্দ্রর সে রকম কোন দুর্বলতাই ছিল না।
প্রত্যুত্তরে এবারে ইন্সপেক্টার আর কোন কথা বললেন না, কেবল মৃদু একটা হাসি তাঁর ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে উঠল।
পুরন্দর চৌধুরীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নাইন্সপেক্টারের ওষ্ঠপ্রান্তেরক্ষীণ হাসির আভাসটা।
তিনি বললেন, আপনি বোধ হয় আমার কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারলেন নাইন্সপেক্টার। কিন্তু সত্যিই আমি বলছি দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব আমাদের। তাকে আমি খুব ভালভাবেই জানতাম। স্ত্রীলোকের ব্যাপারে তার, সত্যি বলছি,কোন প্রকার দুর্বলতাই ছিল না।
এবারে মৃদুকণ্ঠে বসাক বললেন, বু আপনার কথা আমি পুরোখুরি বিশ্বাস করতে পারলাম পুরন্দরবাবু।
কেন বলুন তো?
নেশার কাছে যে মানুষ নিজেকে বিক্রি করতে পারে তার মধ্যে আর যে গুণই থাক কেন, নারীর প্রতি তার দুবর্লতা কখনও জাগবে না, এ যেন বিশ্বাস করতেই মন চায় না। কিন্তু যাক সে কথা। আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, সেই মিস্টিরিয়াস স্ত্রীলোকটি সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন কিনা।
খুববেশী জানবার অবকাশও আমার হয়নি। কারণবেশীক্ষণ তাকে দেখবার আমার অবকাশও হয়নি এবং তার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগও আমি পাইনি।
আপনি তাকে এ বাড়িতে দেখেছিলেন তা হলে?
হ্যাঁ।
কবে?
মাসদেড়েক আগে বিশেষ একটা কাজে কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাকে কলকাতায় আসতে হয় সেই সময়।
তাহলে মাসদেড়েক আগে আপনি আর একবার কলকাতায় এসেছিলেন এর আগে?
হ্যাঁ।
তারপর?
সেই সময় রাত, বোধ করি, তখন দশটা হবে। বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে এখানে দেখা করতে আসি।
অত রাত্রে এসেছিলেন যে?
পরের দিনই ভোরের প্লেনে চলে যাব, তাছাড়া সমস্ত দিনটাই কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তাই রাত্রে ছাড়া সময় করে উঠতে পারিনি।
আচ্ছা, আপনি যে সে দিন রাত্রে এসেছিলেন এ বাড়িতে রামচরণ জানত?
হ্যাঁ। জানে বৈকি। সে-ই তো আমার আসার সংবাদ বিনয়েন্দ্রকে দেয় রাত্রে।
যাক। তারপর বলুন।
বিনয়েন্দ্র আমাকে এই ঘরেই ডেকে পাঠায়। ইদানীং বৎসর খানেক ধরে বিনয়েন্দ্র একটা বিশেষ কি গবেষণা নিয়ে সর্বদাই ব্যস্ত থাকত, কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখলাম—
এই পর্যন্ত বলে পুরন্দর চৌধুরী যেন একটু ইতস্তত করতে লাগলেন।
বলুন। থামলেন কেন?
এই ঘরে ঢুকে দেখলাম ঘরের এক কোণে একটা আরাম-কেদারার উপর বিনয়েন্দ্র গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে। আর একটি তেইশ-চব্বিশ বছরের তরুণী অ্যাপ্রন গায়ে ঐ টেবিলটার সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন একটা এক্সপেরিমেন্ট করছেন-হাতে একটা তরল পদার্থপূর্ণ টেস্ট টিউব নিয়ে। আমার প্রবেশ ও পদশব্দ পেয়েও বিনয়েন্দ্র কোন সাড়া না দেওয়ায় আমিই তার সামনে এগিয়ে গেলাম। ডাকলাম, বিনু।
কে? ও, পুরন্দর। এস। তারপর কী সংবাদ? বলে অদূরে কার্যরত তরুণীকে সম্বোধন করে বললে, লতা, সল্যুশনটা হল?
সম্বোধিতা তরুণী বিনয়েন্দ্রর ডাকে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, না। এখনও সেডিমেন্ট পড়ছে।
কথাটা বলে তরুণী আবার নিজের কাজে মনঃসংযোগ করলেন।
বস পুরন্দর। দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বিনয়েন্দ্র বললে।
ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। সেই আলোয় বিনয়েন্দ্রর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।
চোখ দুটো বোজা। সমস্ত মুখখানিতে যেন একটা ক্লান্ত অবসন্নতা। চোখ খুলে যেন তাকাতেও তার কষ্ট হচ্ছে।
বুঝতে আমার দেরি হল না, আমারই যোগান দেওয়া সিংহলী মুক্তার নেশায় আপাতত বিনয়েন্দ্রন্দ্ৰ কুঁদ হয়ে আছে।
শুধু তাই নয়, মাসচারেক আগে শেষবার যে বিনয়েন্দ্রকে আমি দেখেছিলাম এ যেন সে বিনয়েন্দ্র নয়। তার সঙ্গে এর প্রচুর প্রভেদ আছে।
আরো একটু কৃশ, আরো একটু কালো হয়েছে সে। চোখের কোলে একটা কালো দাগ গভীর হয়ে বসেছে। কপালের দুপাশে শিরাগুলো একটু যেন শীত। নাকটা যেন আরও একটু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কেন জানি না ঠিক ঐ মুহূর্তে বিয়েকে দেখে আনন্দ হওয়ার চাইতে মনে আমার একটু যেন দুঃখই হল।
বুঝলাম, পুরোপুরিভাবেই আজ বিনয়েন্দ্র নেশায় কবলিত। এর আগে দেখেছি, সে রাত বারটা সাড়ে বারটার পর শুতে যাবার পূর্বে সাধারণত নেশা করত কিন্তু এখন দেখছি সে সময়ের নিয়ম-পালন বা মর্যাদা আর অক্ষুন্ন নেই। এতদিন নেশা ছিল তার সময়বাঁধা, ইচ্ছাধীন। এখন সেই হয়েছে নেশার ইচ্ছাধীন। নেশার গ্রাসে সে আজ কবলিত।
বিনয়েন্দ্র আমাকে বসতে বললে বটে, কিন্তু তার তখন আলোচনা কিছু করবার বা কথা বলবার মত অবস্থা নয়।
কিছুক্ষণ বসে থেকে আবার ডাকলাম, বিনু!
অ্যাঁ? অতি কষ্টে যেন চোখ মেলে তাকাল বিনয়েন্দ্র। তারপর বললে, তুমি তো রাতটা আছ। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নাও। কাল সকালে শুনব তোমার কথা।
বললাম, রাত্রে আমি থাকব না। এখুনি চলে যাব।
ও, চলে যাবে। যাও এবারে কিছু বেশী করে পার্লস পাঠিয়ে দিও তো, একটা দুটোয় আজকাল আর শানাচ্ছে না হে।
বিনয়েন্দ্রর কথায় চমকে উঠলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ফিরে তাকালাম অদূরে দণ্ডায়মান সেই তরুণীর দিকে।
তরুণীর দিকে তাকাতেই স্পষ্ট দেখলাম, সে যেন আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল, অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। সে যে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল বুঝতে আমার কষ্ট হল না।
নেশার ঘোরে আবার হয়ত বেফাঁস কি বলে বসবে বিনয়েন্দ্র, তাই আর দেরি না করে ফিরে আসবার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই বিনয়েন্দ্র আবার চোখ মেলে তাকিয়ে বললে, চললে নাকি পুরন্দর?