দেখুন সুশান্তবাবু, কাকাকে খুব ভাল করে চিনবারই আমার সৌভাগ্য হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর মত আনস্ক্রপলাস, স্বার্থান্ধ, অর্থপিশাচ লোক ভীরুর মত আত্মহত্যা করবে, বিশেষ করে ঐ বয়সে-যখন মান সম্রম প্রতিপত্তি অর্থ সব তাঁর করায়ত্ত, আর যে-ই বিশ্বাস করুক কথাটা অন্ততঃ আমি করতে রাজী নই।
কথাগুলো বলতে বলতে মধুসূদন সরকার যেন বেশ একটু উত্তেজিতই হয়ে ওঠেন এবং ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলে বেশ একটু বিস্মিত ভাবেই ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই স্বর্গগত কাকা সম্পর্কে ভাইপোর শ্রদ্ধাটা যেন একটু বিসদৃশ বলেই ওদের মনে হয়।
কিন্তু মধুসূদনের বক্তব্য যে তখনও শেষ হয়নি পরক্ষণেই বোেঝা গেল। কারণ তিনি আবার তখনই বলতে শুরু করেছেন।
আমার কথাগুলো শুনে হয়তো আপনারা সকলেই একটু বিস্মিত হচ্ছেন। কিন্তু আমার একটা কি দোষ জানেন, সত্য চিরদিনই অপ্রিয় এবং যত অপ্রিয়ই হোক না কেন, সত্যভাষণে কখনও আমি পেছপাও হই না। আর স্পষ্টবক্তা ও চিরদিন সত্যাশ্রয়ী বলেই কাকার অপ্রিয়ভাজন আমাকে একদিন হতে হয়েছিল।
কি রকম?
বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর দশ বৎসর আগে কাকা অন্যায়ভাবে আমাদের ঠাকুরদামশাইয়ের এক উইল দেখিয়ে তাঁর সম্পত্তির সমান অংশ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন বলেই তার প্রতিবাদে আমার প্রতি তিনি একান্ত বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু যাক সেসব কথা। অতীত। তাছাড়া সেই কাকাও আজ আর বেঁচে নেই যখন, ঐসব পুরাতন কথা ভেবেও তখন আর কোন লাভ নেই। তবু কাকা আমাদের প্রতি যে ব্যবহারই করে থাকুন না কেন একদা, তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারে সাহায্য করতে দারোগাবাবু আপনি যোগ্যতম ব্যক্তি জেনে আপনারই সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এসেছি।
আমি আপনাকে একটা উপায় বলে দিতে পারি মিঃ সরকার। সহসা আবার সুশান্তই কথা বললে।
নিশ্চয়ই, বলুন?
আপনি কিরীটী রায়ের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন?
না।
শোনেননি?
না। শুনলেনই তো, দীর্ঘদিন বাইরেই আমার কেটেছে।
আপনি মিঃ রায়ের সাহায্য নিন। আমি হলফ করে বলতে পারি, সত্যিই যদি ব্যাপারটা, আমরা সকলেই যা অনুমান করছি-হত্যাই করা হয়ে থাকে সারদাবাবুকে, তাহলে সে হত্যার পিছনে যে রহস্যই থাকুক না কেন, জানবেন কিরীটী রায়ের সাহায্য নিলে নিশ্চয়ই সেটা আপনি জানতে পারবেন।
কিন্তু তাঁর সঙ্গে তো আমার কোন পরিচয় নেই সুশান্তবাবু, আমার কথায় তিনি কি আসবেন! তাঁর পারিশ্রমিক অবশ্যই যা তিনি চান আমরা দিতে রাজি আছি। মধুসূদন সরকার বললেন।
বেশ, আমি লিখব তাঁকে। সুশান্ত বললে।
অতঃপর সেরাত্রের মত মধুসূদন সরকার সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
সেই রাত্রেই সুশান্ত কিরীটীকে চিঠি দিল।
প্রিয়বরেষু,
নিশ্চয়ই সুশান্ত ঘোষালকে ভুলে যাননি। বৎসরখানেক পূর্বে, মনে আছে বোধ হয় আপনার, সেই চেতলার অবিনাশ মল্লিকের কেসে আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হবার সৌভাগ্য হয়েছেল। যাহোক আজ তার চাইতেও বিচিত্র একটা মামলার রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে স্থানীয় একজন ভদ্রলোক আপনার সাহায্য চান। অবিশ্যি কেবল তিনিই নন—আমি এবং আমার বন্ধু, এখানকার থানা অফিসারও ব্যাপারটার একটা মীমাংসার জন্য ইনটারেস্টেড, তাই এই পত্র আপনাকে দিচ্ছি। কলকাতার বিখ্যাত জুয়েলারী ফার্ম সরকার ব্রাদার্সের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। তারই মালিক সুবিখ্যাত ধনী প্রৌঢ় সারদাচরণ সরকারকে দিন পনের পূর্বে একদিন সকালে তাঁর শয়নঘরে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিস্তারিত বিবরণ হয়তো সংবাদপত্রেই আপনার নজরে পড়ে থাকবে ইতিমধ্যে। ময়না তদন্তে জানা গিয়েছে।–ইট ইজ এ কেস অফ নিকোটিন পয়েজনিং। ব্যাপারটা কিন্তু আমাদের কারোরই সুইসাইড কেস বলে মনে হচ্ছে না, তার কারণ ঐ গৃহে মৃত সারদাচরণের পার্সোন্যাল অ্যাটেনডেন্ট ছিলেন এক তন্বী সুন্দরী শকুন্তলা দেবী, যিনি এখনও সরকার ভিলা ছেড়ে যাননি। এখানে। এলে বাকি কথা সব জানতে পারবেন। যদি আসেন তা জানালে স্টেশনে উপস্থিত থাকব।
প্রীত্যর্থী
সুশান্ত ঘোষাল
তিন দিন পরেই চিঠির জবাব এল।
সুভাষণেষু,
কাল সন্ধ্যার গাড়িতে রওনা হচ্ছি। সাক্ষাতে বাকী কথা হবে। স্টেশনে থাকবেন আপনাদের বাসাতেই উঠব। নমস্কার।
ভবদীয়—কিরীটী রায়
সুশান্তর ইচ্ছা ছিল সংবাদটা পাওয়া মাত্রই মধূসুদন সরকারকে জানায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি ভেবে আর জানালো না।
পরের দিন প্রত্যুষেই একেবারে কিরীটীকে সঙ্গে করে নিয়ে সরকার ভিলায় যাবে ঠিক করল।
কলকাতার ট্রেনটা আসে রাত প্রায় সাড়ে নটা নাগাদ। স্টেশনটি ঘোট। দুধারে বাঁধানো প্ল্যাটফরম।
একপাশে অ্যাসবেসটাসের সেডের নীচে স্টেশন মাস্টারের ঘর, যাত্রীদের ওয়েটিং রুম ও টিকিট ঘর পাশাপাশি।
নির্দিষ্ট সময়েই কলকাতার ট্রেনটা এসে প্ল্যাটফরমে দাঁড়াল। যাত্রী সামান্যই।
স্টেশনের টিমটিমে কেরোসিনের আলোয় সুশান্ত এদিক-ওদিক অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকায়।
কিন্তু আকাঙিক্ষত ব্যক্তিটি তার নজরে পড়ে না।
তবে কি মিঃ রায় এলেন না।
সহসা ঐ সময় পশ্চাৎ থেকে মৃদুকণ্ঠের সম্বোধন এল, এক্সকিউস মি, আপনিই বোধ হয় সুশান্তবাবু?
কে? মিঃ রায় নিশ্চয়ই—
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, নিঃসংশয়ে।
পরিধানে ধুতি, গায়ে কালো রংয়ের গ্রেট কোট, চোঁখে সেই কালো মোটা সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা।
মুখে পাইপ। সেই পরিচিত চেহারা।