তাহলে?
যাক গে, বড়কর্তাদের জানিয়ে দিয়েছি। এখন তাঁদের যা করবার করুন। বড়ঘরের ব্যাপারেই সব আলাদা। বেটা বুড়োর তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তার পার্সোন্যাল অ্যাটেনডেন্টের খুপসুরৎ থেরা দেখলেই মাথা ঘুরে যাবার যোগাড়!
বিনয় বললে, বৃন্দাবনবাবুকে আজও তো সকালে সরকার-ভিলার সামনে দেখেছিলাম। ভদ্রলোক এখানেই আছেন বুঝি এখনও?
শুধু তিনি কেন, শকুন্তলা দেবীটিও তো শুনলাম এখনও রয়েছেন এখানেই।
দেখ, বৃন্দাবন আর ঐ শকুন্তলা দেবীরই কাজ হয়তো! সুশান্ত এবারে বলে।
বিচিত্র নয়।
কিন্তু ব্যাপারটা যতই বিচিত্র হোক, স্থানীয় লোকেদের যে সে সম্পর্কে কোন দুশ্চিন্তা আছে সেরকম কিছু মনে হল না।
কারণ ব্যাপারটা যেন ক্রমশঃ ধামাচাপা পড়বারই যোগাড় হয়েছিল।
এমন সময় প্রায় আরও দিন সাতেক অর্থাৎ দুর্ঘটনার পক্ষকাল বাদে সন্ধ্যার সময় বিমলের থানার অফিসঘরের মধ্যেই বসে সুশান্ত, বিনয়, ফ্যাটি গুপ্ত ও বিমল সেন রীতিমত আড্ডার আসর যখন জমিয়ে তুলেছে, তখন বাইরের বারান্দায় অপরিচিত একটা জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।
বেশ ভারী জুতোর শব্দ।
পরক্ষণেই ভারী, মোটা অপরিচিত গলা শোনা গেল দরজার ওপাশে, দারোগাবাবু আছেন?
কে? ভেতরে আসুন!
একটু পরেই ভারী জুতোর মশমশ শব্দ তুলে দীর্ঘকায় এক আগন্তুক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
ঘরের মধ্যে টেবিলের উপরে রক্ষিত প্রজ্বলিত টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেরই অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিটা গিয়ে প্রায় যেন একই সঙ্গে আগন্তুকের উপর পড়ল।
আগন্তুক দু হাত তুলে নমস্কার জানালেন, নমস্কার। আমি আসছি সরকার-ভিলা থেকে। আমার নাম মধুসূদন সরকার।
চকিতে সকলের নামটা মনে পড়ে যায় যেন। মধুসূদন সরকার!
পক্ষকাল আগে সারদাবাবুর মৃত্যুর তদন্ত করতে গিয়ে ভৃত্য দশরথের মুখেই ঐ নামটি ওরা শুনেছিল।
অতএব নামটা তাদের অপরিচিত নয়—যদিও মানুষটা অপরিচিত।
০৬. মধুসূদন সরকার
মধুসূদন সরকার।
পরিধানে দামী সার্জের মভ কলারের লংস।
গায়ে গলাবন্ধ কালো ভেনিসিয়ান সার্জের লম্বা কোট।
পায়ে ডার্বী সু।
চেহারাটা বেশ লম্বা-চওড়া ও বলিষ্ঠ।
মাথার চুল পালিশ করা। রগের দুপাশে সামান্য পাক ধরেছে চুলে, বয়সের ইঙ্গিত।
মুখে ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি। পাকানো গোঁফ।
ছড়ানো চৌকো চোয়াল। চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা।
বসুন, বিমল সেন বললে।
বিশেষ একটা ব্যাপারে সাহায্যপ্রার্থী হয়েই আমি এসেছি দারোগাবাবু।
খালি একটা চেয়ারে বসতে বসতে মধুসূদন সরকার বললেন।
বলুন।
আপনারা হয়তো জানেন না, মৃত সারদা সরকার আমার কাকা ছিলেন। অবিশ্যি কথাটা আপনাদের না জানবারই কথা। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় বছর দশেক আগে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। নানা জায়গায় ঘুরে শেষ দুটো বছর আমি রেঙ্গুনেই ছিলাম। মাত্র পরশু জাহাজ থেকে নেমেছি। সেখানেই আমাদের কলকাতার দোকানের ম্যানেজার মৃগাঙ্কবাবুর মুখে সব শুনলাম। প্রথমটায় ভেবেছিলাম ব্যাপারটা বুঝি একটা পিওর অ্যাণ্ড সিম্পল সুইসাইডই। কিন্তু আজ সকালে এখানে এসে বৃন্দাবন ও শকুন্তলা দেবীর মুখে সব ব্যাপার আদ্যোপান্ত শুনে মনে হচ্ছে-দেয়ার মাস্ট বি সাম ফাউল প্লে সামহোয়ার। তাই আপনার কাছে সোজা চলে এলাম।
কিন্তু–
শুনুন দারোগাবাবু, কথাটা তাহলে খুলেই বলি, আমি চাই ব্যাপারটার একটি মীমাংসা হোক। কাকা যদি সত্যি-সত্যিই আত্মহত্যা করে থাকেন তো কথাই নেই, তা যদি না হয়, যদি সত্যিই তাঁকে কেউ হত্যা করে থাকে, তাহলে যেমন করেই হোক হত্যা-ব্যাপারটার একটা কিনারা করতে চাই আমরা দু ভাই-ই। একসময় কাকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক যতই তিক্ত হোক না কেন, কাকা আমাকে স্নেহ করতেন। এই দীর্ঘ দশটা বছর দুরে থাকলেও, নিজের ব্যবহারের জন্য অনুতাপের আমার অন্ত ছিল না। কতবার মনে হয়েছে ফিরে এসে ক্ষমা চেয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেব। হাজার হোক গুরুজন। তাছাড়া আমরাই তো তাঁর সব ছিলাম। বলতে বলতে একটু যেন দম নিয়ে পুনরায় শুরু করলেন, ক্ষমা চাইব বলে কত আশা করে ফিরে এসেছিলাম কিন্তু সে সুযোগটুকুও ভগবান দিলেন না। শেষের দিকে অশ্রুতে কণ্ঠস্বর মধুসূদনের রুদ্ধ হয়ে যায়।
বেশ। কিন্তু
না না, দারোগাবাবু, এ ব্যাপারে আপনার আমি সাহায্য চাই আর আপনাকে সাহায্য করতেই হবে। এমন কি এই অনুসন্ধানের ব্যাপারে খরচপত্র যাই হোক সব আমি দেব।
উপরওয়ালাকে অবিশ্যি সবই আমি জানিয়েছি–
সে আপনাদের আইনের দিক থেকে যা করবার আপনি করুন। কিন্তু শুধু ঐ আইনের উপরেই নির্ভর করে থাকতে আমি চাই না দারোগাবাবু। বেসরকারী ভাবে অনুসন্ধান করবারও যদি প্রয়োজন হয় তাও আমি করতে প্রস্তুত জানবেন।
বেসরকারী ভাবে তদন্ত?
হ্যাঁ, এদেশে ওসব ব্যাপার নেই বটে, তবে বইতে পড়েছি বিলেতে নাকি আছে। সেই রকম কিছু–
দেখুন মধুসূদনবাবু, এখানে আমি অবিশ্যি তৃতীয় ব্যক্তি-সম্পূর্ণ আউটসাইডার, কথা বললে এবারে সহসা সুশান্ত, কিন্তু ব্যাপারটা আমিও গোড়া থেকে অল্পবিস্তর জানি, তাই যদি একটা কথা বলি অন্যায় ধরবেন না, বিশেষ করে একটু আগে আপনি যা বললেন তার উত্তরে–
নিশ্চয়ই না। কিন্তু আপনি–
বিমলই অতঃপর সকলের পরিচয়টা করিয়ে দিল।
কিন্তু কি যেন বলছিলেন সুশান্তবাবু–
আপনার কাকার মৃত্যুর ব্যাপারটা হত্যাই বা ভাবছেন কেন?