ও, দশরথই তাহলে সর্বপ্রথম এ বাড়িতে আজ দেখেছে—জানতে পেরেছে যে আপনার কাকামশাই মৃত!
না।
তবে?
সর্বপ্রথম জানতে পারে ব্যাপারটা শকুন্তলাই।
শকুন্তলা? আই সি। তা তিনি কখন জানতে পারেন?
খুব ভোরে। শকুন্তলা কাকার ঘরে গিয়েই—
কিন্তু অত ভোরে সে ঘরে কেন তিনি গিয়েছিলেন?
কাকার বাগানে নানা জাতের সব রেয়ার গোলাপ আছে, সেই গোলাপের গাছেরই কি সব সার সম্পর্কে শকুন্তলা নাকি গতকাল দুপুরে কি একটা সারের সম্পর্কে বই থেকে পড়ে কাকাকে বলেছিল, তাই কাকা বলেছিলেন শকুন্তলাকে আজ খুব ভোরে তাঁর সঙ্গে বাগানে যাবার জন্যে যখন তিনি যাবেন। তাই বোধ হয় শকুন্তলা কাকার ঘরে গিয়েছিল তাঁকে ডাকতেই।
আই সি। আচ্ছা এই শকুন্তলা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা মিঃ সরকার?
নো নো-সি ইজ অ্যাবসলুটলি বিয়ও অল সাসপিসন। সি ইজ এ পারফেক্ট লেডি।
ঠিক আছে। আপনি এবারে অনুগ্রহ করে শকুন্তলা দেবীকে এ ঘরে যদি একটু পাঠিয়ে দেন মিঃ সরকার! তাঁকেও আমার কিছু প্রশ্ন করবার আছে।
নিশ্চয়ই, এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি-বলে বৃন্দাবন সরকার সোফা ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন তখুনি।
বৃন্দাবন সরকার ঘর ছেড়ে চলে যেতেই মৃদুকণ্ঠে এতক্ষণে সুশান্ত কথা বলে, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস বিমল?
কি? বিমল সুশান্তর মুখের দিকে তাকালো।
কাকার অ্যাটেনডেন্ট অথচ ভদ্রলোকের ভাইপোটি এমন অবলীলাক্রমে শকুন্তলা, শকুন্তলা বলে নামটা উচ্চারণ করছিলেন–
মৃদু হেসে বিমল বললে, অল্পবয়সে স্ত্রী-বিয়োগ ঘটেছে, তা একটু-আধটু–
হুঁ, তাই তো মনে হচ্ছে শকুন্তলার দুষ্মন্ত—
সহসা ঐসময় ঘরের বাইরে পদশব্দ শুনে বিমল বললে, চুপ-শকুন্তলা আসছে বোধ হয়!
শকুন্তলা এসে ঘরে প্রবেশ করল।
ছিপছিপে রোগা, একটু বেঁটে এবং মুখখানি মঙ্গোলিয়ান টাইপের হলেও অদ্ভুত একটা আলগা শ্ৰী আছে যেন শকুন্তলার চেহারায় ও মুখখানিতে।
দেখার সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মাথার পর্যাপ্ত চুল দুটি বিনুনীর আকারে বক্ষের দুপাশে লম্বমান।
সাধারণ একটি কালোপেড়ে তাঁতের শাড়ি যৌবনপুষ্ট দেহে চমৎকার মানিয়েছে।
হাতে একগাছি করে কঙ্কণ এবং দুকানে দুটি নীলার টাব। আর দেহে কোথাও কোন অলঙ্কার বা আভরণ নেই। পায়ে চপ্পল। কিন্তু ঐ সামান্য অনাড়ম্বর বেশেই যেন শকুন্তলার রূপ একেবারে ফুটে বের হচ্ছিল।
এ যেন সত্যিই সেই কবিমানসী বনবিহারিণী হরিণী শকুন্তলা।
নমস্কার, আপনিই শকুন্তলা দেবী? বিমল বললে।
প্রতি-নমস্কার জানিয়ে নিঃশব্দে মৃদুভাবে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল শকুন্তলা।
বসুন।
শকুন্তলা উপবেশন করল।
০৫. কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই
কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে শকুন্তলা দেবী!
বলুন। মৃদুকণ্ঠে কথাটি বললে শকুন্তলা।
গলাটিও মিষ্টি।
মিঃ সরকারের মুখে শুনলাম আপনি সারদাবাবুকে বইটই পড়ে শোনাতেন, তাঁর লেখাপড়ার কাজও সব করে দিতেন?
হ্যাঁ।
তাহলে কতকটা তাঁর পার্সোন্যাল অ্যাসিস্টেন্টের মতই আপনি ছিলেন বলুন এখানে তাঁর কাছে? বিমল বলে।
তাই বলতে পারেন।
হুঁ। আচ্ছা কাল রাত্রের দিকে শেষ কখন তাঁর সঙ্গে আপনার কথাবার্তা হয়?
সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত এই লাইব্রেরীতেই তো আমরা ছিলাম। রাত নটার পর এখান থেকে আমি চলে যাই। রাত তখন সোয়া এগারোটা হবে, তিনি আবার আমাকে ডেকে পাঠান তাঁর ঘরে।
অত রাত্রে হঠাৎ ডেকে পাঠালেন যে?
ওঁর ঘুমের ট্যাবলেটের শিশিটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, সেটা খুঁজে দেবার জন্য।
খুঁজে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
কোথায় ছিল সেটা?
ওঁর ঘরে রাইটিং টেবিলের ড্রয়ারেই ছিল, কতকগুলো কাগজের তলায় চাপা পড়েছিল শিশিটা।
তারপর?
আমি যখন বের হয়ে আসছি, আমাকে বললেন দশরথকে বলে দেবার জন্যে, তাঁকে এক কাপ চা পাঠিয়ে দিতে।
অত রাত্রে চা!
হ্যাঁ, চা-পানের ব্যাপারে তাঁর কোন সময়-অসময় ছিল না। যখন-তখনই খেতেন। অতিরিক্ত চা-পানের জন্যই তো ডাক্তার চৌধুরী বলেছিলেন ওঁর ইনসমনিয়া হয়।
দিনে-রাতে কত কাপ চা খেতেন?
তা কুড়ি-পঁচিশ কাপ তো হবেই। আর খেতেনও অত্যন্ত স্ট্রং লিকারের চা।
আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, আপনি যখন সারদাবাবুর চিঠিপত্র লেখা ও হিসাবপত্র দেখার ব্যাপারে সাহায্য করতেন, তখন আশা করি নিশ্চয়ই আপনি কনফিডেন্সেই ছিলেন?
হ্যাঁ, উনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
স্বাভাবিক। আচ্ছা সারদাবাবু লোকটি কিরকম ছিলেন বলে আপনার ধারণা?
খুব শান্ত, ধীর ও বিবেচক প্রকৃতির লোক ছিলেন সারদাবাবু। ভেবেচিন্তে তবে কোন মতামত প্রকাশ করতেন।
আচ্ছা আপনি তো শুনলাম আট মাসের মত এখানে আছেন, তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কখনো আপনার সঙ্গে কোন আলোচনা হয়নি?
না। কখনো কোন কারণেই ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কারও সঙ্গে কোন আলোচনা করতেই তিনি ভালবাসতেন না। সে ব্যাপারে তাঁকে অত্যন্ত রিজার্ভই বরং মনে হয়েছে বরাবর।
বৃন্দাবনবাবুর প্রতি তাঁর মনোভাবটা কেমন ছিল?
ভালই। বৃন্দাবনবাবুকে অত্যন্ত তিনি ভালবাসতেন বলেই তো আমার মনে হয়।
অতঃপর বিমল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করল, এবারে আপনি কি করবেন ঠিক করেছেন কিছু?
ইট ইজ টু আর্লি টু থিঙ্ক দ্যাট! তাছাড়া যে কাজের জন্য এখানে আমি এসেছিলাম তার যখন আর প্রয়োজন হবে না, চলেই যাব।
আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, ধন্যবাদ, আপনি যেতে পারেন।
শকুন্তলার পরে ঘরে ডাকা হল পুরাতন ভৃত্য দশরথকে।