বয়স ত্রিশ থেকে বত্রিশের মধ্যে হবে বলেই চেহারা দেখে মনে হয় ভদ্রলোকের।
তবে বেশ হৃষ্টপুষ্ট-যাকে বলে গোলগাল চেহারা।
গৌরবর্ণ। পরিধানে ধপধপে দামী কাঁচির ধুতি ও গায়ে দামী একটা শাল জড়ানো। পায়ে দামী চপ্পল।
মাথার চুল রুক্ষ এলোমেলো। মুখে একদিনের দাড়ি। বোঝা যায় তখনো ক্ষৌরকর্ম সমাধান হয়নি।
বসুন, বসুন বৃন্দাবনবাবু। আমাদের কথাবার্তা বসে বসেও চলতে পারে। বিমল বললে।
বৃন্দাবন আর দ্বিরুক্তি না করে পুনরায় সোফার উপরে বসে পড়লেন তখুনি।
এবং বিমলই অতঃপর প্রশ্ন করতে শুরু করে বৃন্দাবনবাবুকে।
আপনি কি এখানেই বরাবর থাকেন?
না। তবে প্রায় প্রতি হপ্তায়ই আসি। পরশু রাত্রে গাড়িতে এসেছিলাম, আজই সকালে আমার কলকাতায় ফিরে যাবার কথা ছিল।
ও। আচ্ছা আপনার কাকামশাইয়ের মৃত্যুটা আপনার কি বলে মনে হয় মিঃ সরকার?
কি বলব কিছুই বুঝতে পারছি না দারোগাবাবু! ব্যাপার যা দেখছি তাতে তো মনে হচ্ছে সুইসাইডই করেছেন। কিন্তু–
কি?
তাঁর মত লোক সুইসাইড করতে পারেন অ্যাটঅল, আমার চিন্তারও অতীত। তাছাড়া সুইসাইডই বা তিনি করতে যাবেন কেন এ বয়সে, কোন হেতুই তো ছিল না।
আপাতদৃষ্টিতে সেটা আমাদের চোখে না পড়লেও একেবারে যে থাকতে পারেই না তাও তো নয় মিঃ সরকার। গম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিল বিমল।
তা অবিশ্যি ঠিক। তবে—
তাছাড়া উনি সুইসাইডই যে করেছেন, তাই বা আমরা ধরে নিচ্ছি কেন মিঃ সরকার।
কি বলতে চান আপনি? কথাটা বলে উৎকণ্ঠিত ভাবে তাকালেন বৃন্দাবন সরকার বিমলের মুখের দিকে।
হ্যাঁ, এ কেস অফ হোমিসাইডও তো হতে পারে। তাঁকে কেউ হত্যাও তত করে থাকতে পারে।
০৪. বিমলের অতর্কিত প্রশ্নটা
বিমলের অতর্কিত প্রশ্নটায় যেন সহসা ভূত দেখার মতই চমকে উঠলেন বৃন্দাবন সরকার। এবং কয়েকটা মুহূর্ত তাঁর কণ্ঠ দিয়ে একটি শব্দও বের হল না।
তারপর যেন আত্মগতভাবেই বললেন বৃন্দাবন, এ–এ আপনি কি বলছেন দারোগাবাবু?
বলছিলাম ওঁকে কেউ হত্যাও তত করে থাকতে পারে!
হত্যা? হাউ অ্যাবসার্ড? হাউ ইমপসিবিল! না, না-হত্যা তাঁকে কে করবে আর করতেই যা যাবে কেন?
আরে মশাই, কে করতে পারে সে তো পরের কথা। আপাততঃ সেদিকটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে বৈকি। কিন্তু যাক সে কথা। তার আগে কতকগুলো কথা আমার জানা প্রয়োজন।
কিন্তু–
শুনুন মিঃ সরকার, জানেন তো আমাদের পুলিসের মন বড় সন্দিগ্ধ, তাই অসম্ভবকে আমরা সম্ভব বলেই ধরে নিই। যাক যা জিজ্ঞাসা করছিলাম, গতকাল যখন আপনি এখানে ছিলেন আপনার কাকামশাইয়ের সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার কথাবার্তা হয়েছে?
হ্যাঁ, তা হয়েছে বৈকি।
কি বিষয়ে আপনাদের কথাবার্তা হয়েছিল বলতে যদি আপনার আপত্তি না থাকে—
আপত্তি থাকবে কেন? কথাবাতা গতকাল যা হয়েছে তা আমাদের ব্যবসা সম্পর্কেই। কারণ ঐ ব্যবসা সম্পর্কে কথাবার্তা বলতেই হপ্তায় অন্ততঃ দুবার করে এখানে আমাকে আসতে হচ্ছিল ইদানীং।
গতকাল আপনার কাকার কোন কথায় বা ব্যবহারে কোন চাঞ্চল্য ভাবান্তর লক্ষ্য করেছিলেন কি কোন সময়?
না কাকার প্রকৃতিই ছিল যেন সোবার, শান্ত। কখনও মনে পড়ে না, কোন কারণে কাকাকে জ্ঞানতঃ চঞ্চল বা উত্তেজিত হতে দেখেছি। অতি বড় আনন্দের ব্যাপারেও যেমন তাঁর উল্লাস ছিল না, তেমনি নিদারুণ ক্ষতি বা নিরানন্দের ব্যাপারেও তাঁকে কখনও তেমন ম্রিয়মাণ মুহ্যমান হতে দেখিনি বড় একটা।
হুঁ। আচ্ছা তার কোন শত্রু ছিল বলে জানেন?
শত্রু! না
এ বাড়িতে যেসব চাকরবাকর ও অন্যান্য যারা সব আছে তারাও কি, আপনি মনে করেন, বিয়ও অল সাসপিসন?
নিশ্চয়ই। সবাই তো অনেকদিনের পুরনো লোক, একমাত্র শকুন্তলা ছাড়া।
শকুন্তলা! হুঁ ইজ সি?
কাকার পার্সোন্যাল অ্যাটেনডেন্ট সে। কাকার লেখাপড়ার কাজ করে দেওয়া, তাঁকে বই পড়ে শোনানো ইত্যাদির ব্যাপারে মাস-আষ্টেক হল কাকা তাকে অ্যাপয়েন্ট করেছিলেন।
হুঁ। তাঁর সঙ্গেও কথাবার্তা বলতে চাই।
ডেকে আনব?
না, একটু পরে। একটা কথা মিঃ সরকার, কাল রাত্রে সর্বশেষ কখন আপনার কাকামশাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা হয়?
কাকা সাধারণতঃ একটু রাত করেই শুতেন, কারণ—
থামলেন কেন, বলুন?
অনেকদিন থেকে হার্টের প্যালপিটেশনে ভুগছিলেন, তারপর ইদানীং মাসকয়েক থেকে শুনছিলাম তিনি এক নতুন উপসর্গ ইনসমনিয়াতেও ভুগছিলেন নাকি।
নিদ্রাহীনতার আর হৃৎপিণ্ডের দৌর্বল্য?
হ্যাঁ।
সেজন্য কোন ঔষধপত্র খেতেন কি?
মধ্যে মধ্যে শুনেছি কোরামিন আর ইদানীং ডাক্তারের পরামর্শে ঘুমের জন্য লুমিনল ট্যাবলেট খেতেন। শকুন্তলা দেবীই একদিন আমাকে বলছিল কথাটা।
কোন ডাক্তার তাঁকে দেখতেন?
কলকাতার ডাঃ আর. এন. চৌধুরীই বরাবর তাঁকে দেখতেন। হপ্তায় একবার তিনি এখানে আসতেন।
হুঁ। আচ্ছা তারপর যা বলছিলেন বলুন গতরাত্রের কথা।
চিরদিনই আমার একটু সকাল সকাল সোওয়া অভ্যাস। রাত দশটার মধ্যেই শুয়ে পড়ি আমি। কিন্তু কাকার সঙ্গে তাঁর ঘরেই বসে গতরাত্রে জরুরী ব্যবসা-সংক্রান্ত কতকগুলো আলোচনা করতে করতে কাল শুতে আমার প্রায় পৌনে এগারোটা হয়ে গিয়েছিল।
সারদাবাবুর ঘরে আপনি কাল কত রাত পর্যন্ত ছিলেন মনে আছে?
রাত এগারোটা বাজলে আমি উঠি।
হুঁ। তাহলে রাত এগারোটায় শেষ আপনি গতকাল তাঁকে জীবিত দেখেছিলেন?
হ্যাঁ। আজ সকালে কখন জানলেন যে উনি মৃত?
দশরথই এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে সংবাদটা দেয়।