কথাগুলো বলে কিরীটী তাকাল মধুসূদনের মুখের দিকে।
রোমকষায়িত দৃষ্টিতে তাকালেন মধুসূদন সরকার কিরীটীর দিকে নিরুপায় পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের মত।
আর শকুন্তলা চোখ নামিয়ে নিল একান্ত অসহায়ের মতই যেন।
আবার কিরীটী তার অর্ধসমাপ্ত কাহিনীর বিবৃতির মধ্যে ফিরে যায়, জুয়োতে সর্বস্বান্ত হয়ে অনন্যোপায় সাহেব আবার ফিরে এলেন বাংলাদেশে দীর্ঘ দশ বৎসর পরে এবং সঙ্গে এবারে এলেন তাঁর বিবিসাহেবা, কারণ জুয়োর আড্ডায় পরিচয়টা উভয়ের তখন নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে ফিরে সরকার সাহেব কাকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে গলাধাক্ক খেলেন। এবারে কি উপায় করা যায় যখন ভাবছেন, ঐ সময় কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে সারদাচরণের কাছে পাঠিয়ে দিলেন শকুন্তলাকে। এবারে কিন্তু হার হল না, কারণ শকুন্তলার রূপ দেখে প্রৌঢ় সারদাচরণের মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। অতএব বহাল হল কুন্তলা তার। কাজে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সরকার সাহেবের। যে প্ল্যান করে শকুন্তলাকে তিনি কাকার কাছে চাকরি করার জন্য পাঠালেন সেটা গোড়াতেই বানচাল হয়ে গেল। কারণ পঞ্চশরের বানে কাহিল হলেন সারদাচরণ আর ঐশ্বর্যের লোভে শকুন্তলা তার পূর্ব চুক্তি বোধ হয় ভুলে গেলেন। যা হয়েছিল সাহেবের সঙ্গে। ফলে নাটকের দৃশ্যান্তর হল। মধুসূদন দেখলেন বেগতিক। কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়বার পাত্র তিনি নন। তাতেই কেতুর আবির্ভাব ঘটল সরকার ভিলায়, কাজও হাসিল হল বটে সারদাচরণেরই নিজ হাতে তৈরী রোজ স্পেইং সলুশনের মধ্যস্থিত বিষ নিকোটিনের সাহায্যে, কিন্তু দশরথ আসল পরিচয়টা জেনে ফেলল, ফলে হতভাগ্য দশরথকেও মরতে হল ঐ মারাত্মক নিকোটিন বিষে।
এই পর্যন্ত বলে কিরীটী একটু থামল।
তারপর? প্রশ্ন করল সুশান্ত।
তারপর? তারপর আসতে হল আমাকে। এদিকে উইলের আসল মর্মকথা মধুসুদন তার বন্ধুর কৃপায় পূর্বাহ্নেই জেনেছিলেন। এবং দশরথ ও সারদাচরণকে সরিয়ে সাহসও তার বেড়ে গিয়েছিল—অতএব অর্থের লোভে হতভাগ্য বিজনবাবুকেও এবারে মরতে হল। পূর্বেই বলেছি সারদাবাবু ও দশরথের মৃত্যু ও তাদের ময়না তদন্তের রিপোর্ট থেকে আমার মনে দুটি সন্দেহ হয়। এক—যেভাবে তাদের মৃত্যু ঘটেছে তাতে করে হত্যাকারী বাইরের কেউ নয়—ভিতরেরই। দুই-প্রথম মৃত্যুর সঙ্গে দ্বিতীয় মৃত্যুর যোগাযোগও আছে এবং ঐভাবে হত্যা করা কোন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে সম্ভবপর নয়। তখনো হত্যার মোটিভ বা উদ্দেশ্যটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। পরিষ্কার হল উইলের মর্মকথা শোনবার পর। এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে সারদাচরণের গৃহে তার ড্রয়ারের মধ্যে প্রসাধনদ্রব্যগুলো দেখে ও বাগানে সেদিন শকুন্তলা দেবীর খোঁজে সেই চায়না বাঁশের ঝাড়ের কাছে গিয়ে চুরুটের শেষাংশ দেখে, শকুন্তলা ও মধুসূদনবাবুকে ঘিরে যে সন্দেহটা আমার মনে দানা বাঁধবার চেষ্টা করছিল সেটা যেন ক্রমশঃ শক্ত হয়ে উঠতে লাগল। এবং সেই মুহূর্তেই এল আকস্মিকভাবে বিজনবাবুর মৃত্যু।
কিরীটী এই পর্যন্ত বলে আবার থামল।
২৪. পাইপটায় টোবাকো ভরে
পাইপটায় টোবাকো ভরে তাতে অগ্নিসংযোগ করে কিরীটী পাইপে গোটা-দুই টান দিয়ে আবার তার কাহিনী শুরু করল :
বিজনবাবুর মৃত্যুটা যদিও মর্মান্তিক, তথাপি তার মৃত্যু ঐভাবে সেদিন না ঘটলে হয়ত এত তাড়াতাড়ি এই জটিল রহস্য আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠত কিনা সন্দেহ। কিন্তু তার মৃত্যুর পরই ক্রমশঃ হত্যাকারী আমার দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। আর সেই কারণেই আপনাদের এখানে আমি কৌশলে বন্দী করেছিলাম সে-সময়।
কিন্তু কেন যে কৌশলে ওদের আমার সাহায্যে এই সরকার ভিলায় আপনি বন্দী করেছিলেন সেটাই এখনও বুঝতে পারিনি মিঃ রায়! বললে বিমল সেন।
মানুষের নার্ভেরও একটা সীমা আছে মিঃ সেন! তারই পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম আমি এই আশাতে যে শেষ পর্যন্ত মানসিক পীড়নে কারো মুখ দিয়ে কোন কথা যদি বের হয়ে পড়ে। হলও তাই। হত্যাকারী তখন আন্দাজ করতে পেরেছে সে আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর সেই আতঙ্কেই সে যখন অনন্যোপায় হয়ে তার দক্ষিণ হস্ত গোকুলকে শেষ করে দেবে বলে মনস্থ করল। এবং তাকে হত্যা করতে গিয়েই সে দুটি মারাত্মক ভুল করল—যার ফলে সে আমার দৃষ্টির সামনে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল।
মারাত্মক ভুল! প্রশ্ন করল বিমল সেন।
হ্যাঁ মিঃ সেন, দুটি মারাত্মক ভুল। এক হচ্ছে, হত্যা করতে গিয়ে রিভলবারের সাহায্য নিয়ে এবং দুইসেই নিকোটিনের শিশিটি আমার হাতে অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ে তুলে দিয়ে। রিভলবার দিয়ে হত্যা করতে গিয়েই নিজের দেহেও তাকে ক্ষতের সৃষ্টি করতে হল এবং নিকোটিনের শিশির গায়ে তার হাতের আঙুলের ছাপও পাওয়া গেল-হত্যার মারাত্মক দুটি প্রমাণ। কিন্তু এবারে আমাকে উঠতে ববে—আজকের শেষ গাড়িটা আমাকে ধরতেই হবে
বিমল সেন বললেন, কেন, আজ রাতটা থেকে যান না।
উপায় নেই—
কেন?
কাল আমার বিয়ে।
বিয়ে! সে কি? পাত্রী কে? কার মেয়ে? কি নাম? সুশান্তই জিজ্ঞাসা করল।
কার মেয়ে তা দিয়ে কি হবে? নাম তার কৃষ্ণ, সুশান্তবাবু।
কৃষ্ণা?
হ্যাঁ, একটি পার্শী মেয়ে—
পার্শী মেয়েকে আপনি বিয়ে করবেন! সুশান্ত বললে, বাংলাদেশে কি মেয়ে ছিল না?
বন্ধু, তুমি জান প্রেম অন্ধ—
হুঁ, তা অঘটনটা ঘটল কোথায়?
সিংহলে।
তাহলে সত্যিই এতদিনে কিরীটী রায় কুমারত্ব ঘুচাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।