এ কি! কি সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি কথাটা বলে সর্বাগ্রে ডাঃ অধিকারীই আহত মধুসূদনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
কি হয়েছে? ব্যাপার কি দাদা? বৃন্দাবনও এগিয়ে যান।
কিরীটী ততক্ষণে এগিয়ে গিয়ে ভূপতিত মৃত রক্তাক্ত দেহটা উটে দিতেই যেন সকলে চমকে উঠল মৃতের দিকে তাকিয়ে এবারে।
গুলিবিদ্ধ মৃত ব্যক্তি আর কেউ নয়-ভৃত্য গোকুল।
এ কি! এ যে দেখছি গোকুল! বললেন মিঃ মল্লিক।
হ্যাঁ-ওই বেটাই। যন্ত্রণা-ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন মধুসূদন সরকার, ঘরের দরজা আমার ভেজানোই ছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়তে পড়তে বোধ হয় একটু তন্দ্রামত এসেছিল, হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হতেই চেয়ে দেখি আমার জলের গ্লাসে শিশি থেকে কি একটা ঢালছে ঐ গোকুল। তাই দেখেই সঙ্গে সঙ্গে আমি বালিশের তলা থেকে রিভলবারটা নিয়ে ওকে গুলি করতে যাব হঠাৎও আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। ধস্তাধস্তি করতে করতে একটা ফায়ার আমার হাতে লাগে, আর একটায় বোধ হয় ওই বেটা ফিনিশ হয়েছে
ঘরের মেঝেতেই একটা বেঁটে মত কালো শিশিও পাওয়া গেল মৃত গোকুলের পাশেই।
কি সর্বনাশ! ডাঃ অধিকারী বললেন, শেষ পর্যন্ত ঐ বেটাই—
পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে শিশিটা আলগোছে মেঝে থেকে তুলে নিয়ে বৃন্দাবন সরকারের দিকে চেয়ে কিরীটী বললে, থানায় বিমলবাবুকে এখনি একটা খবর দিন বৃন্দাবনবাবু!
থানায়?
হ্যাঁ, যান—গোকুলের ব্যাপারটা বিমলবাবুকে এখুনি জানানো কর্তব্য।
বেশ।
বৃন্দাবন সরকার তখুনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
এবার কিরীটী ডাঃ অধিকারীর দিকে তাকিয়ে বললে, ওঁর হাতের উৎটা পরীক্ষা করে দেখলেন ডাঃ অধিকারী?
নাঃ, এই দেখছি-বলে ডাঃ অধিকারী মধুসূদন সরকারের হাতের উৎটা পরীক্ষা করে বললেন, না সামান্যই, সুপারফিসিয়াল একটা স্কিন ডিপ উণ্ডের উপর দিয়ে গিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
তা হোক, ড্রেস করে দিন। কিরীটী বললে শান্তকণ্ঠে।
ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই থানা থেকে বিমল সেন এসে গেল। সে আবার মধুসূদন সরকারের জবানবন্দি নিল। জবানবন্দি নিতে নিতেই একসময় বললে বিমল, যাক, শেষ পর্যন্ত যে বেটা ঘায়েল হয়েছে এই রক্ষে! নইলে আরও যে এমন কতগুলো খুন করত কে জানে! উঃ সাংঘাতিক!
সকলে লাইব্রেরী ঘরের মধ্যেই জমায়েত হয়েছিলেন আজও।
ডাঃ অধিকারী বললেন, যা বলেছেন মিঃ সেন। মধু আজ খুব বেঁচে গিয়েছে।
লাকিই বলতে হবে। মিঃ মল্লিক বললেন।
যাহোক সে-রাত্রিও অতিবাহিত হল একসময়।
এবং পরের দিন সকাল দশটার ট্রেনেই মিঃ মল্লিক ও ডাঃ অধিকারী চলে গেলেন কলকাতায়।
কিরীটীও তাদের সঙ্গে একই ট্রেনে কলকাতায় গেল।
পরের দিন শকুন্তলাও কলকাতা চলে গেল।
দিন সাতেক বাদে।
বৈকালের দিকে সরকার ভিলায় যখন কিরীটী, সুশান্ত ও বিমল সেন এসে প্রবেশ করল, মধুসূদন সরকার তখন বাইরের ঘরে বসে একজন বৃদ্ধ বাঙালী ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
ওদের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে মধুসূদন সাদরে আহ্বান জানালেন, আসুন, আসুন–বসুন।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওদের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বললেন, তাহলে আজ আমি উঠি মিঃ সরকার। তাহলে ঐ কথাই রইল। সামনের সপ্তাহেই রেজেস্ট্রি হবে।
বেশ।
ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। আপনারা বসুন মিঃ রায়, আমি কাউকে চা দিতে বলে আসি।
না, না—আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না মিঃ সরকার, বসুন। চা একটু আগেই থানা থেকে খেয়ে আসছি। কিরীটী বললেন।
আমার এখানেও না হয় এক কাপ করে থোক। বলেই মধুসূদন মৃদু হেসে কথাটা শেষ করলেন, এখানে চা খেতে আপনাদের ভো আর ভয় নেই। চা রহস্যের তো মীমাংসা হয়েই গিয়েছে, কি বলেন মিঃ রায়!
তা হয়েছে বটে। তবে চা পরে হবেখন। আপনি বসুন।
কিরীটীর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বাইরের বারান্দায় কয়েকজোড়া মিলিত জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।
কারা যেন আসছে বলে মনে হচ্ছে! মিঃ সরকার বললেন।
বোধ হয় ডাঃ অধিকারী, বৃন্দাবনবাবু ওঁরা সব এলেন। বললে কিরীটী।
সত্যিই পরমুহূর্তেই ডাঃ অধিকারী, তার পশ্চাতে মিঃ মল্লিক, বৃন্দাবন সরকার ও শকুন্তলা এসে ঘরে প্রবেশ করল।
কি ব্যাপার ডাঃ অধিকারী, আপনারা–
মধুসূদনকে কথাটা শেষ করতে দিল না কিরীটী। সে বললে, সকলকেই আজ এখানে আমি ডেকে আনিয়েছি।
কিন্তু ব্যাপারটা কি?
আপনি শুনে হয়ত খুশী হবেন মিঃ সরকার, কিরীটী বললে, সারদাবাবু দশরথ, বিজনবাবু ও গোকুলের হত্যারহস্যের মীমাংসা
মীমাংসা! কথাটা বললেন বৃন্দাবন সরকার।
হ্যাঁ বৃন্দাবনবাবু, সেই রহস্যের মীমাংসার জন্যই আজ সকলে আমরা এখানে জমায়েত হয়েছি।
কিরীটীর কথায় ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই কেমন যেন একটু বিব্রত ও অস্বােয়াস্তি বোধ করছেন বোঝা গেল।
কিরীটী কিন্তু একান্ত নির্বিকার।
একটা অখণ্ড স্তব্ধতা যেন ঘরের মধ্যে থমথম করছে।
২২. ধীরে ধীরে কিরীটী
ধীরে ধীরে কিরীটী তার বক্তব্য শুরু করে :
শুনে নিশ্চয়ই সুখী হবেন আপনারা, গত এক মাস ধরে পর পর যে চারটি নিষ্ঠুর হত্যা এই সরকার ভিলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই হত্যা-রহস্যের পশ্চাতে যে আছে সে যত চালাক ও চতুর হোক না কেন, আমার চোখে শেষ পর্যন্ত সে ধুলো দিতে পারেনি–
এসব আপনি কি বলছেন মিঃ রায়? তবে কি গোকুল হত্যাকারী নয়? প্রশ্ন করলেন বৃন্দাবন সরকার।
শান্তকণ্ঠে কিরীটী বলে ওঠে, না, না বৃন্দাবনবাবু, ইট ওয়াজ নট গোকুল।
তবে কে-কে?
একসঙ্গে সকলেরই কণ্ঠ হতে যেন ঐ কথাগুলি উচ্চারিত হল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় একই সময়ে।