সে কি! অধস্ফুট কণ্ঠে প্রশ্ন করেন এবারে ডাঃ অধিকারী।
হ্যাঁ, ডাঃ অধিকারী। আরও কেউ ছিল এবং এখনও তিনি পূর্ববৎ হত্যাকারীর লিস্টে আছেন।
কিরীটীর শেষের কথায় সকলে আবার ভীতদৃষ্টিতে পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
মৃত্যু–আবার কার জন্য মৃত্যু এখানে ওৎ পেতে আছে কে জানে?
এ কি সর্বনেশে কথা!
কিরীটী একটু থেমে আবার তখন বলতে শুরু করেছে, তবে আমার বিশ্বাস, বেচারী গোকুল হয়ত দোষী নয়। তা সে যাই হোক, বর্তমানে আমাদের সব চাইতে বেশী ভাববার কথা হচ্ছে, পর পর যেভাবে তিনটি মৃত্যু এ বাড়িতে ঘটেছে সেরকম নাটকীয় ব্যাপারের আর যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই দিকেই আমাদের দৃষ্টি দেওয়া কর্তব্য নয় কি?
কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না মিঃ রায়-সহসা কিরীটীকে বাধা দিয়ে ডাঃ অধিকারী বললেন, দশরথের কথা ছেড়ে দিলেও সারদা আর বিজনের মৃত্যু যদি ঐ নিকোটিন বিষপানেই তাদের অজ্ঞাতে হয়ে থাকে তো গ্লাসে ও কাপে–
কিরীটী শেষ করতে দিল না ডাঃ অধিকারীকে কথাটা, বললে, কেমিক্যাল অ্যানালিসিসে, নিকোটিন বিষ গ্লাসে পাওয়া উচিত ছিল ও কাপেও পাওয়া উচিত ছিল, তাই না?
হ্যাঁ, মানে–
ডাঃ অধিকারী, গ্লাসেও যেমন নিকোটিনের নামগন্ধ পাওয়া যায়নি, ঐ কাপেও পাওয়া যেত না। তাই মিথ্যে আমি কাপটা আর কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের জন্য বিমলবাবুকে পাঠাতে বলিনি।
তবে?
কিন্তু কেন? গ্লাসে ও কাপে যদি সত্যই নিকোটিন দেওয়া হয়ে থাকে তো কেন নিকোটিন অ্যানালিসিসে কাপে বা গ্লাসে পাওয়া যাবে না? সহসা কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা ঋজু ও ধারাল হয়ে ওঠে। সে বলতে থাকে, পাওয়া যায়নি ও যাবে না—তার কারণ সারদাবাবুর ঘরে যে গ্লাসটা পাওয়া গিয়েছিল এবং গতকাল সোফার তলায় যে কাপটা পাওয়া গিয়েছে, আদপেই। সে গ্লাস এবং সেই কাপ সারদাবাবু বা বিজনবাবু ব্যবহার করেননি তাদের মৃত্যুর পূর্বে।
হোয়াট ড়ু ইউ মিন, মিঃ রায়? তার মানে?
তীক্ষ্ণ একটা চীৎকারের মতই যেন ডাঃ অধিকারীর প্রশ্নটা কিরীটীর প্রতি নিক্ষিপ্ত হল।
এবারে শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে কিরীটী বললে, একসাটলি তাই ডাঃ অধিকারী। বলতে বলতে সহসা জামার পকেট থেকে একটা কাপ বের করে সম্মুখস্থিত টেবিলের উপরে রক্ষিত ক্ষণপূর্বের যে কাপটি মধুসূদনের সোফার তলা থেকে নিচু হয়ে কিরীটী বের করেছিল সেই কাপটি অন্য হাতে তুলে নিয়ে সকলের দিকে তাকিয়ে আবার বললে, দেখুন সকলে, এই দুটি কাপ হুবহু এক। অথচ আপনাদের চোখের সামনে—এই কিছুক্ষণ পূর্বে যে কাপটি আমি সোফার নিচে থেকে বের করেছিলাম সে কাপে আদৌ মধুবাবু আজ চা পান করেননি তার মৃত্যুর অভিনয়ের সময়। তিনি চা পান করেছিলেন আসলে এইমাত্র আমার জামার পকেট থেকে যে কাপটি বের করলাম সেই কাপে!
সর্বনাশ! তবে কি—
ঠিক তাই ডাঃ অধিকারী। সেই কারণেই সারদাবাবুর ঘর থেকে যে গ্লাসটা পাওয়া গিয়েছিল সেই গ্লাস কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে যেমন কোন নিকোটিনের ট্রেস মাত্রও পাওয়া যায়নি, তেমনি গত সন্ধ্যায় বিজনবাবুর মৃত্যুর পর যে কাপটি আমি সোফার নিচে পেয়েছিলাম সে কাপটিতেও নিকোটিনের ট্রেস বা নামগন্ধও পাওয়া যেত না। সো ইউ অল অ্যানডারস্ট্যাও নাউ? আসল ব্যাপার, গতকাল অত্যন্ত ট্যাক্টফুলি তার কাজ হাসিল করেছিল হত্যাকারী। যদিও প্রথম দুবারে ট্যাক্টফুলনেসের তার প্রয়োজন হয়নি, কারণ বিষপ্রয়োগের সময় নো বডি ওয়াজ প্রেজেন্ট দেয়ার!
কিন্তু হাউ, কেমন করে? প্রশ্ন করলেন আবার ডাঃ অধিকারী।
কেমন করে, তাই না ডাক্তার? আসল বিষমিশ্রিত কাপটি হত্যাকারী গতকাল কি ভাবে আমাদের চোখের সামনে ম্যানেজ করে অন্য একটা কাপ রিপ্লেস করল! ওয়েল-ভাবতে গেলে যদিও ব্যাপারটা দুর্বোধ্য ও অবিশ্বাস্য, তথাপি হত্যাকারী বা খুনীর পক্ষে গতকাল কাপটা রিপ্লেসের ব্যাপারে যা প্রয়োজন ছিল সেটা হচ্ছে তার খানিকটা তত্রপ, ক্ষিপ্রতা এবং খানিকটা নার্ভ-যে দুটোই অবিসংবাদিত ভাবে হত্যাকারীর ছিল। কালকের ব্যাপারটা একবার সকলে আবার কুল ব্রেনে ভেবে দেখুন। অতর্কিতে যখন বিজনবাবু হঠাৎঅসুস্থ হলেন বিষপান করে, আর অজ্ঞাতে আমরা সকলেই যেন কিছুটা ননপ্লাসড় হয়ে পড়েছিলাম ঘটনার আকস্মিকতায় ও আমাদের সকলের মনই তখন বিজনবাবুর দিকে-আমাদের সকলের সেই অসতর্ক মোমেন্ট-টুকুরই ত্বরিত সদ্ব্যবহার করেছিল হত্যাকারী অর্থাৎ ঐ মুহূর্তেই সে ঠিক আজকের আমার মতই আসল কাপটি অন্য একটি নির্দোষ কাপ দিয়ে সবার অলক্ষ্যে রিপ্লেস করেছিল। আশা করি এবারে আপনারা সকলেই আমার আজকের অনুষ্ঠানের সত্যকার উদ্দেশ্যটা উপলব্ধি করতে পারছেন।
কিরীটীর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অধস্ফুট চিৎকার করে বললেন মধুসূদন সরকার, কে-কে তবে কাপটা সরিয়েছিল?
নিঃসন্দেহে এ সে-ই মিঃ সরকার, যে সারদাবাবু দশরথ ও বিজনবাবুকে হত্যা করেছে। গম্ভীরকণ্ঠে কিরীটী প্রত্যুত্তর দিল।
কিন্তু কে-কে সে?
কে—সেটাই তো আমাদের খুঁজে এখন বের করতে হবে মিঃ সরকার—এবং সেটা যতক্ষণ
সম্ভব হচ্ছে, হত্যাকারীকেও আমরা স্পট-আউট করতে পারব না। সে আমাদের নাগালের বাইরেই অন্ধকারে থেকে যাবে।
আপনি-আপনি জানেন মিঃ রায়?
হয়ত জানি বা হয়ত জানি না, মিঃ সরকার। কিন্তু তার চাইতেও বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ। যে কথাটা সেটা হচ্ছে-আপনারা সকলেই কাল যাঁরা ঐ দুর্ঘটনার সময়ে এ ঘরে উপস্থিত ছিলেন, আজও আছেন এবং আবার কিছুক্ষণ পূর্বে যা আমি আপনাদের বলেছি সেটাই রিপিট করছি। যে মৃত্যুর অভিনয় আজ মধুসূদনবাবুকে দিয়ে করিয়েছি ক্ষণপূর্বে এই ঘরে সেটা অভিনয় এবং নিছক মিথ্যা হলেও, আবার আচমকা যে কোন মুহূর্তেই হয়ত ঠিক ঐভাবেই কারো না কারো আপনাদের মধ্যে মৃত্যু তার সত্য নিয়ে দেখা দিতে পারে। ঠিক হয়ত ঐভাবেই। হত্যাকারী আবার কারও উপরে অ্যাটেম্পট নিতে পারে, যদি তার হত্যার প্রয়োজন না এখনও ফুরিয়ে গিয়ে থাকে। তাই সকলের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, যাতে গত তিনবারের হত্যার মত আবার ঐ নৃশংস ব্যাপার ভবিষ্যতে না ঘটে। যদি আপনাদের মধ্যে কেউ এমন। কিছু জানেন যা এখনও পর্যন্ত পুলিস জানতে পারেনি, অথচ যার সাহায্যে পুলিসের এই হত্যা-রহস্যের তদন্ত সহজ হয়—সে কথাটা অন্তত আমাকে খুলে বলুন। জানবেন এই সময় কোন কিছু ঐ হত্যা-রহস্য সম্পর্কে গোপন রাখা মারাত্মক হবে। বলুন, আমি আবার অনুরোধ জানাচ্ছি সকলের কাছে, বলুন!