তারপর ডাঃ অধিকারী। একে একে তারপর সকলেই যে যার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
সর্বশেষে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন মধুসূদন সরকার।
এবং দুই চুমুক চা পান করবার পরই ঠিক গত সন্ধ্যার মতই অব্যক্ত একটা যন্ত্রণায় মুখ-চোখ বিকৃত করে মধুসূদন সরকার চেয়ারের উপর ঢলে পড়লেন সঙ্গে সঙ্গে।
তার হাত থেকে চায়ের কাপটা মেঝেতে পড়ে গেল।
সর্বাগ্রে বৃন্দাবন সরকারই চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শঙ্কাজড়িত ব্যাকুলকণ্ঠে বলে উঠলেন, কি-কি হল?
ডাঃ অধিকারী বললেন, সর্বনাশ! আবার পয়েজন নাকি?
ঘরের আর সকলেই নির্বাক। আর প্রত্যেকের হাতেই তখন ধরা রয়েছে যাক যাঁর চায়ের কাপটি।
কিরীটী তার চায়ের কাপটা একপাশে নামিয়ে মধুসূদনবাবুর কাতরোক্তি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়েছিল, এবারে সে এগিয়ে এসে হতবাক বিমূঢ় সকলের দিকে বারেকের জন্য দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে মধুসূদন সরকারকে স্পর্শ করে মৃদুকণ্ঠে বললে, হি ইজ ডেড!
২০. আর্তকণ্ঠে যেন কথাটা প্রশ্নের মত
ডেড! আর্তকণ্ঠে যেন কথাটা প্রশ্নের মতই পুনরুচ্চারণ করলেন বৃন্দাবন সরকার।
হ্যাঁ, স্টোন ডেড!
সকলে স্তম্ভিত নির্বাক।
ডাঃ অধিকারী একটু পরে মৃতদেহের সামনে একসময় ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত নির্বাক হলেও—মধুবাবুর চায়ের কাপটা কোথায় গেল?-বলতে বলতে কিরীটী নিচু হয়ে হাত ঢুকিয়ে উপবিষ্ট মধুসূদনের সোফার তলা থেকে চায়ের কাপটা তুলে নিল। তারপরই কাপটা হাতে নিয়ে মধুসূদন সরকারকে লক্ষ্য করে বললে, স্পেনডিড! সত্যিই চমৎকার অভিনয় করেছেন মধুবাবু, উঠুন—এতটা সাকসেস্ সত্যিই আমি আশা করিনি।
বিস্মিত হতবাক সকলের চোখের সামনে এবারে মধুসূদন সরকার চোখ মেলে সোজা হয়ে বসলেন।
কিরীটী ডাঃ অধিকারীর দিকে চেয়ে এবারে বললে, বাধ্য হয়েই আজকের এই অভিনয়টুকু মিঃ সরকারকে দিয়ে আমাকে করাতে হল ডাক্তার অধিকারী। কিন্তু কেন করেছিলাম এবারে
আমি সেই কথাটাই বলব।
কিরীটীর কথায় ও মধুসুদনকে চোখ মেলে উঠে বসতে দেখে এতক্ষণে যেন সকলে সম্বিৎ ফিরে পান। সকলেই একটা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
সকলেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিরীটী তখন আবার বলছে, হ্যাঁ, কোন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই আজকের এই অভিনয়ের অনুষ্ঠানটি আমি মধুবাবুর সঙ্গে গতরাত্রে পরামর্শ করে করেছি এবং আজকের ব্যাপারটা নিছক একটা অভিনয় হলেও, গতকাল সন্ধ্যায় ঠিক অনুরূপ ব্যাপারটি নির্মম ও নিষ্ঠুর সত্য বলেই আমরা জানি। কারণ গত সন্ধ্যায় ঠিক আজকের মতই কাপে এক চুমুক দিয়েই বিজনবাবু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন আমাদের সকলেরই চোখের সামনে-এবং যদিও ময়না তদন্তের ফলাফল এখনো আমরা জানতে পারিনি, তথাপি আমি আপনাদের সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারি, হতভাগ্য বিজনবাবুর মৃত্যুর পশ্চাতেও আছে আগের দুবারের মতই মারাত্মক নিকোটিন বিষপ্রয়োগই।
ঘরের মধ্যে সকলেই স্তব্ধ, বিমূঢ় ও নির্বাক।
কিরীটী আবার বলে, নিকোটিন বিষপ্রয়োগেই যদি বিজনবাবুর মৃত্যু হয়ে থাকে তো কাল নিশ্চয়ই তার চায়ের কাপের মধ্যেই আমাদের অলক্ষ্যে হয় নিজ হাতে বা অন্য কারও সহযোগিতায় হত্যাকারী ঐ মারাত্মক নিকোটিন বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। রান্নাঘরের পাশের ঘরে গত সন্ধ্যায় শকুন্তলা দেবী গোকুলের সাহায্যে আমাদের জন্য চা তৈরী করেছিলেন বলেই আমরা জানি। এবং ঐ সময় তারা দুজনেই বাইরে গিয়েছিলেন—শকুন্তলা দেবী দুবার ও গোকুল একবার। কাজেই ঐ গোকুল বা শকুন্তলা দেবী যদি চায়ে না বিষ মিশিয়ে থাকেন–
সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকলের দৃষ্টি অদূরে উপবিষ্ট শকুন্তলার উপর গিয়ে পতিত হল।
না, না, আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, সহসা যেন চাপা আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল শকুন্তলা, বিষ আমি দিইনি—
কিন্তু কিরীটী শকুন্তলার সেই আর্ত চিৎকারে যেন কর্ণপাতও করল না। সে যেমন বলছিল বলতে লাগল, যা, কেবল শকুন্তলা দেবী বা গোকুলই নয়—কাল এ-বাড়িতে যাঁরা ঐ সময় উপস্থিত ছিলেন তাদের যে কারও পক্ষেই বিজনবাবুর চায়ের কাপে বিষ মেশানো সম্ভবপর ছিল। অর্থাৎ যে কেউ বিষ মেশাতে পারেন।
আবার ঐ সময় চিৎকার করে উঠলেন বৃন্দাবন সরকার, হাউ অ্যাবসার্ড! এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়?
ঠিকই বলছি বৃন্দাবনবাবু, একমাত্র আমি ও শচীবিলাসবাবু ব্যতীত কাল সকলেই আপনারা এ ঘর থেকে ঐ সময়ের মধ্যে বেরিয়েছেন আমার স্পষ্ট মনে আছে।
সকলেই এবারে চুপ।
তাই যদি হয়, তাহলে আপনাদের যে কারো পক্ষেই গতকাল চায়ের কাপে বিষ মেশানো সম্ভবপর ছিল এ কথাটা নিশ্চয়ই কেউ ডিনাই করতে পারবেন না! যাক যা বলছিলাম, তারপর ট্রেতে করে চায়ের যে কাপগুলো গোকুল নিয়ে এল তার মধ্যেই কোন একটি কাপে নিকোটিন বিষমিশ্রিত চায়ে চুমুক দিয়েই নিজের অজ্ঞাতে বিজনবাবু আমাদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করলেন। কথা অবিশ্যি এর মধ্যে একটা আছে। গোকুলই সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়েছিল। নিজে যদি দোষী হয় তো সে জেনেই পূর্বাহ্নে বিজনবাবুর হাতে বিষমিশ্রিত চায়ের কাপটি তুলে দিয়েছিল; আর সে যদি নির্দোষী হয়ে থাকে তো অজ্ঞাতেই সে বিজনবাবুর হাতে ঐ বিষের কাপটি তুলে দিয়েছিল। সেক্ষেত্রে আর একটা সন্দেহ জাগতে পারে আমাদের মনে। বিজনবাবুর হাতে অজ্ঞাতে বা না জেনে যদি গোকুল বিষের কাপটি তুলে দিয়েই থাকে, তাহলে কি বিজনবাবুর মৃত্যুটা অ্যাকসিডেন্টাল! আর তাই যদি হয়, হত্যাকারীর এইম কার উপরে ছিল? কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বিজনবাবুর মৃত্যুটা একেবারে অ্যাকসিডেন্টাল নয়। বিজনবাবু হত্যাকারীর লিস্টে তত ছিলেনই-আরো কেউ ছিল!