তাই আমার ধারণা ডাঃ অধিকারী। এর আগে এই বাড়িতেই দুটি নৃশংস হত্যার ব্যাপার আপনি তো শুনেছেন–
হ্যাঁ, শুনেছি।
একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন, পর পর এই তিনটি মৃত্যুই আকস্মিক ও রহস্যজনক হলেও একই সূত্রে গাঁথা।
কিন্তু–
বুঝতে পারছি ডাঃ অধিকারী, আপনি কি বলতে চান। প্রথম দুটো হত্যার সময় অকুস্থানে তৃতীয় কোন ব্যক্তি ছিল কিনা আপাততঃ সেটা যদিও আমরা জানি না বা জানতে পারিনি বটে, কিন্তু ভেবে দেখুন তৃতীয় মৃত্যুর সময় আমরা এতগুলো লোক সজ্ঞানে অকুস্থানে উপস্থিত ছিলাম!
তাই তো ব্যাপারটা এখন আমার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।
তা না হলেও এটা তো আপনি স্বীকার করবেন, প্রথম ও দ্বিতীয় দুটো হত্যাই হয়েছে। তীব্র নিকোটিন বিষপ্রয়োগে?
তাহলে দশরথের মৃত্যুর কারণও আপনার ধারণা মিঃ রায় ঐ একই? ধারণা নয়, তাই। কারণ আজ একটু আগে বিমলবাবু আমাকে সেকথা বলে গেলেন। তাহলেই ভেবে দেখুন, বিষপ্রয়োগের কোন প্রমাণ—অর্থাৎ কে কার দ্বারা, কি উপায়ে তাদের বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল সেটার কোন প্রমাণ এখনও পর্যন্ত না পাওয়া গেলেও ময়নাতদন্তে তাদের দেহে বিষ পাওয়া গিয়েছে,-যার দ্বারা তাদের যে বিষের ক্রিয়াতেই মৃত্যু ঘটেছে সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত। তারপর দেখুন, তিন-তিনটে মৃত্যু একই বাড়ির বিভিন্ন ঘরে হয়েছে এবং একই বাড়ির লোক তারা!
কিন্তু এটাই তো আমি বুঝতে পারছি না মিঃ রায়, আপনার কথা যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া যায়ই, তাহলে এই ধরনের ডায়বলিক্যাল মার্ডারের কি উদ্দেশ্য কার থাকতে পারে?
সেটা তো পরের কথা। কিন্তু একটা কথা কি জানেন ডাঃ অধিকারী, এসব ব্যাপারে বরাবরই আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার দ্বারা দেখেছি, সরলভাবে বিচার করে দেখতে গেলে প্রত্যেকটি এই ধরনের হত্যার ব্যাপারেই মোটিভ বা উদ্দেশ্য, অপরচুনিটি বা সুযোগ এবং প্রবাবিলিটি বা সম্ভাবনা তিনটি জিনিসই থাকবে। অবিশ্যি এর মধ্যে মোটিভই হচ্ছে সর্বপ্রধান-মুখ্য। অন্য দুটি গৌণ। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে প্রথম ও তৃতীয় হত্যার মোটিভ আমাদের চোখের সামনে থাকলেও, দ্বিতীয় হত্যার মোটিভটি অবিশ্যি তত স্পষ্ট নয়।
কি মোটিভ? ডাঃ অধিকারী আবার প্রশ্ন করলেন।
কেন? সেই চিরাচরিত মোটিভ–অর্থ!
অর্থ?
হ্যাঁ, অর্থম্ অনর্থম্! সারদাচরণ সরকারের সুবিপুল সম্পত্তি, যার হদিস আজই আমরা শচীবিলাসবাবুর কাছ থেকে কিছুক্ষণ মাত্র আগে পেয়েছি–
তাই যদি হয় তো দশরথ কেন নিহত হল?
দশরথ বেচারী প্রথম হত্যার ব্যাপারে এমনভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিল,-যে কারণে হত্যাকারীর চোখে তার মৃত্যুটা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল।
মধুসূদনবাবু অবিশ্যি সেরাত্রে সকলের আহারের ভাল ব্যবস্থাই করেছিলেন। কিন্তু আহারের এতটুকু রুচিও কারো ছিল না বুঝি, তাই সকলেই গিয়ে নিয়মরক্ষার জন্য খাবার টেবিলে বসলেন মাত্র।
এবং একসময় সকলে আবার টেবিল ছেড়ে উঠে যে যাঁর নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে যেন শ্লথপায়ে প্রবেশ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
সেরাত্রে নিদ্রা যে কারও চোখে আসবে না বা আসতে পারে না, সকলেই অবিশ্যি সেটা জানতেন—তবু কেউ যেন আর বসে থাকতে পারছিলেন না।
যে যার নির্দিষ্ট শয়নঘরে প্রবেশ করে যেন সন্ধ্যা থেকেই সেই একটানা দুর্বিষহ মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে সে রাতের মত নিশ্চিন্ত হলেন কতকটা।
মধুসূদন সরকারের পাশের ঘরেই কিরীটীর শয়নের ব্যবস্থা হয়েছিল সে রাত্রে।
রাত্রি গভীর।
সরকার ভিলার ঘরে ঘরে একে একে আলো নিভে গিয়েছে।
কিরীটী তার ঘরের খোলা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বাইরের অন্ধকারের দিকে দৃষ্টি মেলে ধূমপান করছিল।
ঘর অন্ধকার।
সরকার ভিলার মৃত্যু-রহস্যের সমাধান করে ওখান থেকে চলে আসবার পূর্বে সুশান্ত প্রশ্ন করেছিল কিরীটীকে, ওভাবে সেদিন সকলকে সরকার ভিলায় আটকে রেখেছিলেন কেন মিঃ রায়?
জবাবে কিরীটী বলেছিল, তা না করলে হয়ত হত্যাকারীকে অত সহজে আমি ধরতে পারতাম না সুশান্তবাবু।
তাহলে বলুন, হত্যাকারীকে আপনি মনে মনে চিনতে পেরেছিলেন ঐদিনই?
তা পেরেছিলাম বইকি! মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দিয়েছিল।
১৯. কিন্তু যাক সে কথা
কিন্তু যাক সে কথা।
সেই রাত্রির কথায়ই ফিরে আসা যাক।
অন্ধকার ঘর।
কাঁচ করে মৃদু শব্দ হতেই চকিতে কিরীটী ঘুরে দাঁড়ালো।
কিরীটীর ঘরের দরজা ভেজানোই ছিল।
নিঃশব্দে সেই দরজার ভেজানো কপাট দুটো যেন ধীরে ধীরে একটু একটু খুলে যাচ্ছে।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে কিরীটী সেই দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
দরজাটা খুলছে।
একটু একটু করে খুলছে।
তারপরই দীর্ঘ একটা ছায়ামূর্তি ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল অন্ধকারে।
কে?
মিঃ রায় জেগে আছেন? আমি—
আসুন। কিন্তু কি ব্যাপার বৃন্দাবনবাবু, এত রাত্রে? ঘুমোননি?
না মিঃ রায়, ঘুম আসছে না।
দাঁড়িয়ে কেন বৃন্দাবনবাবু, বসুন ঐ চেয়ারটায়।
বৃন্দাবন সরকার কিন্তু বসলেন না। দাঁড়িয়েই রইলেন।
মিঃ রায়! একসময় মৃদুকণ্ঠে ডাকলেন।
বলুন?
আপনি আজ সন্ধ্যার সময় যা বললেন, সত্যিই কি আপনি তাই বিশ্বাস করেন?
কি?
এই বাড়িরই একজন—
আমার ধারণা তাই বৃন্দাবনবাবু। শান্তকণ্ঠে কিরীটী বলে কথাটা।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনি মিঃ রায়, আমি–
একটা কথার জবাব দেবেন বৃন্দাবনবাবু?
কি?
শকুন্তলা দেবী সম্পর্কে আপনার সত্যি কি ধারণা?