হুঁ। আচ্ছা মধুসূদনবাবু, চা তৈরী করেছিল কে? বিমল সহসা প্রশ্ন করে।
তা তো জানি না। তবে চাকরদের মধ্যেই কেউ হবে।
কিরীটী ঐ সময়ে বলে, যে ভৃত্যটি এ ঘরে চা ট্রে-তে করে নিয়ে এসেছিল তার নাম গোকুল না, বৃন্দাবনবাবু?
হ্যাঁ।
তাকে একবার ডাকুন তো! কিরীটী বলে।
তখুনি গোকুলকে ডাকানো হল ঐ ঘরে।
ভৃত্যদের মহলেও দুঃসংবাদটা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে।
বেচারী কাঁপতে কাঁপতে ঘরে এসে ঢুকল।
গোকুল, চা কে তৈরি করেছিল আজ? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে দিদিমনি করেছেন, আর আমি সব যোগাড় করে দিয়েছি।
দিদিমণি অর্থাৎ শকুন্তলা দেবী।
আর সেখানে কেউ ছিল? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে। কি
আজ্ঞে না।
চা করতে করতে তুমি বা দিদিমণি একবারও গিয়েছিলে বাইরে ঘর থেকে?
আজ্ঞে আমি একবার গিয়েছিলাম, দিদিমণিও বার-দুই গিয়েছিলেন বোধ হয়।
সেসময় কেউ সে-ঘরে ঢুকেছিল কি?
তা তো জানি না।
হুঁ। আচ্ছা তুমি যেতে পার।
গোকুল কাঁপতে কাঁপতেই আবার চলে গেল।
তাহলে মিঃ রায়–
মধুসূদন সরকারের প্রশ্নে তার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, এমনও তো হতে পারে মধুবাবু, এ ঘরে ট্রে-তে করে চা আসবার পর কেউ কিছু কাপে মিশিয়ে দিয়েছে সবার অলক্ষ্যে, বিশেষ করে আমরা তো সবাই তখন কথাবার্তায় অন্যমনস্ক ছিলাম!
কথা বললেন এবারে বৃন্দাবন সরকার, কিন্তু তাই যদি হয়ে থাকে তো এতগুলো কাপের মধ্যে মাত্র একটা চায়েই বিষ মেশানো হল! এবং সেক্ষেত্রেও কেবল ইচ্ছা করেই যদি কেউ কাউকে হত্যা করবার জন্য আপনার ধারণামতই কাপে বিষ মিশিয়ে থাকে, তাহলে যাকে হত্যা করবার জন্য ঠিক বিষ মেশানো হয়েছিল, সেই বিশেষজন সে কাপটা না নিয়ে যদি এ-ঘরের মধ্যে অন্য কেউ সে কাপটা নিত, তবে কি
নিঃসন্দেহে সে-ই ঐ কাপটার চা পান করত তারই মৃত্যু হত বৃন্দাবনবাবু। সেদিক দিয়ে হয়ত হত্যাকারী একটা চান্সই নিয়েছিল!
চান্স?
হ্যাঁ, কিন্তু কেবল বিজনবাবুর কথাই ভাবছেন কেন? হত্যাকারী হয়ত আপনি, মধুবাবু ও বিজনবাবু-তিনজনের উপরেই অ্যাটেম্পট নিয়েছিল আজ।
সে কি?
আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো তাই বৃন্দাবনবাবু। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলে।
কিন্তু শকুন্তলা দেবীকে একবার ডাকলে হত না মিঃ রায়? বিমল বললে।
ডাকিয়েও কোন কিনারা করতে পারবেন বলে তো আমার মনে হয় না বিমলবাবু আজকের এই রহস্যের! কিরীটী শাস্তকণ্ঠে বললে।
তাহলে?
আপাততঃ ঐ মৃতদেহটা এখান থেকে সরিয়ে ময়নাতদন্তে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আর যতক্ষণ না এই হত্যা-রহস্যের তদন্ত শেষ হয়, কেউ যেন এ বাড়ি থেকে না যান সেই নির্দেশই সকলকে আপনি দিন।
কিরীটীর কথায় সকলেই চমকে তার মুখের দিকে তাকাল।
কিন্তু যাকে কথাটা বলা হল সেই বিমলবাবু কারও দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর কণ্ঠে বললে, তাহলে কেউ আমার পারমিশন ব্যতীত এ বাড়ি ছেড়ে যাবেন না—এই কথাই রইল।
কেউ কোন সাড়া দিল না।
সবাই নির্বাক নিস্পন্দ যেন।
কিরীটী যে তখনকার মত সরকার ভিলা থেকে সকলের যাওয়াই বন্ধ করল তাই নয়, নিজেও সে রাত্রের মত সরকার ভিলা থেকে যাবে না বলেই সুশান্তকে একটা সংবাদ তখুনি বিমলের এক সেপাইয়ের সাহায্যে পাঠিয়ে দিতে বলল।
এবং শুধু সে রাত্রেই নয়।
পর পর আরও চারিটি দিন ও রাত সরকার ভিলার চৌহদ্দির মধ্যে ঐ লোকগুলোকে খাঁচায় আবদ্ধ জানোয়ারের মতই যেন বন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল।
একমাত্র ছুটি পেয়েছিলেন পরের দিন ঐ দল থেকে সারদাচরণের সলিসিটার শচীবিলাসবাবু।
আর কেউ বাইরে পা বাড়াবার হুকুম পাননি দারোগা বিমল সেনের কাছ থেকে কিরীটীরই নির্দেশে।
সত্যি, সে এক বিচিত্র পরিস্থিতি।
বিশেষ করে কথার ছলে সেই রাত্রেই যখন সকলের সামনে দাঁড়িয়ে কিরীটী বলেছিল, সারদাচরণ, দশরথ ও বিজনবাবুর হত্যাকারী একজনই—এবং সে হত্যাকারী তখনও তাদের মধ্যে ঐ সরকার ভিলাতেই উপস্থিত আছে, তখন কিরীটীর কথায় সেরাত্রে উপস্থিত সকলেই মুহূর্তের জন্য পরস্পরের প্রতি অপাঙ্গে দৃষ্টিপাত করে অজানিত এক দুর্বোধ্য আশঙ্কায় মনে মনে শিউরে উঠেছিল বুঝি।
একটা সত্য কথা উচ্চারণের মধ্যে যে এমন একটা ভয় আতঙ্ক থাকতে পারে, সেটা যেন সকলেই সেদিন মর্মে মর্মে অনুভব করেছিল।
অথচ কেউ সেদিন এতটুকু প্রতিবাদও জানাতে পারেনি।
একটা দুর্বোধ্য আতঙ্কে কেমন যেন সব বোবা হয়ে ছিল।
থানা-অফিসার বিমল সেন তো তার চরম নির্দেশটা শুনিয়ে দিয়ে সরকার ভিলার চারিদিকে সর্বদা সতর্ক প্রহরার ব্যবস্থা করে সে রাত্রের মত বিদায় হল, কিন্তু যারা সেই খাঁচার মধ্যে বন্দী রইল তাদের তো একটা থাকবার ও খাবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
সরকার ভিলাতে অবিশ্যি থাকবার জায়গার অভাব ছিল না।
কিরীটীর নির্দেশে তখুনি মধুসূদন সরকার সকলের ব্যবস্থা করবার জন্য চলে গেলেন।
এবং ঘণ্টাখানেক বাদেই মৃতদেহ ঐ লাইব্রেরী ঘর থেকে সরিয়ে বাড়ির বাইরে উদ্যানের মধ্যে যে মালীদের ঘরটা ছিল সেই ঘরে রেখে আসা হল রাত্রের মত।
সকলে এসে নিচের পারলারে জমায়েত হলেন আবার।
প্রৌঢ় ডাক্তার অধিকারী একসময় কিরীটীকে বললেন, এ কি বিশ্রী ঝাটে পড়া গেল বলুন তো মিঃ রায়!
আমি বুঝতে পারছি ডাঃ অধিকারী আপনার মনের অবস্থাটা, কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনি, এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন পথ সত্যিই ছিল না।
কিন্তু সত্যিই কি আপনি মনে করেন মিঃ রায়, আজ যারা এখানে এ বাড়িতে উপস্থিত তাদের মধ্যে সামবডি