উইল পড়া শেষ করে শচীবিলাস উইলটা ভাঁজ করছেন, ভৃত্য ট্রে-তে করে গরম চা নিয়ে এল ঘরে।
ট্রে-টি ছোট এবং তাতে মাত্র চারটি কাপই সাজানো।
মধুসূদন ভূত্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কি, চার কাপ আনলি কেন?
ট্রে-টা ছোট, তাই আনতে পারিনি, এখুনি আনছি। বললে ভৃত্য।
কেন, দুটো ট্রেতে সাজিয়ে দুজনে নিয়ে আসতে পারনি? যত বেটা উজবুক এসে এবাড়িতে জুটেছে! বলে মধুসূদন নিজেই সোফা থেকে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বৃন্দাবন বাধা দিলেন, তুমি ব্যস্ত হচ্ছ কেন দাদা, ও এখুনি নিয়ে আসবে, তুমি বোস।
ভৃত্য তখনও বকুনি খেয়ে ট্রে-টা হাতে করেই দাঁড়িয়ে আছে।
আবার হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখ! কোণের ঐ টেবিলে ট্রে-টা নামিয়ে কাপগুলো হাতে হাতে দে না!
মধুসূদন আবার ঝাজিয়ে উঠলেন ভৃত্যকে।
ভৃত্য এধারে ঘরের কোণে যে বড় টেবিলটা ছিল, সেটার উপর নিয়ে গিয়ে ট্রে-টা নামিয়ে রাখল।
মধুসূদন তখন সেই টেবিলের কাছে এগিয়ে যান।
যা, বাকি কাপগুলো নিয়ে আয়। মধুসূদন আবার বললেন ভৃত্যকে।
ভূত্য বাইরে চলে গেল।
এবং একটু পরে বাকি তিন কাপ চা নিয়ে এসে টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল।
সকলের হাতেই অতঃপর মধুসূদনের নির্দেশে এক কাপ করে চা এগিয়ে দিল ভৃত্য।
তোমরা শুরু কর, আমি আসছি এখুনি। বলে মধুসূদন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন পুনরায়।
সকলেই হাতে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিতে উদ্যত। এবং সর্বাগ্রে বোধ হয় বিজনই চায়ের কাপে চুমুক দিল।
কিন্তু দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার আগেই বিজনের কম্পিত হাত থেকে কাপটা নিচের মেঝের কার্পেটের উপর সশব্দে পড়ে গেল।
এবং সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট একটা কাতরোক্তি করে বিজন যে সোফার উপরে বসেছিল সেই সোফার উপরেই এলিয়ে পড়ল।
কি-কি হল? ব্যাপার কি, বিজনবাবু? বলতে বলতে সকলেই ততক্ষণে যে যার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং বিজনের দিকে এগিয়ে আসে।
কিরীটীর এগিয়ে আসে ক্ষিপ্রপদে।
নিদারুণ যন্ত্রণায় বিজনের সমস্ত মুখের পেশীগুলো তখন কুঞ্চিত ও প্রসারিত হচ্ছে।
দুটি চক্ষু বিস্ফারিত। কি যেন বলবার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না বিজন, কথা জড়িয়ে। যায়।
সকলের উৎকণ্ঠিত চোখের দৃষ্টির সামনেই সহসা বিজনের মাথাটা একপাশে কাত হয়ে পড়ল পরক্ষণেই।
অভাবিত আকস্মিক পরিস্থিতি।
সকলেই শুধু নিস্পন্দ বাক্যহারা নয়, বিমূঢ়।
কিরীটী সর্বাগ্রে বিজনের স্থির-নিস্পন্দ দেহটা বারেকের জন্য স্পর্শ করে ডাঃ অধিকারীর দিকে তাকিয়ে বললে, দেখুন তো ডাঃ অধিকারী—
বিমূঢ় ডাঃ অধিকারী কেমন যেন শ্লথ পায়ে এগিয়ে এলেন কিরীটীর নির্দেশে এবং নিস্পন্দ বিজনের পাল্টা একবার দেখেই তার হাতটা ছেড়ে দিয়ে, বিষণ্ণ কাতর দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন কেবল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই মধুসূদন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে, বিজনকে ঘিরে সকলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উৎকণ্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করলেন, কি–ব্যাপার কি?
বিজন ইজ ডেড মধুসূদন! ডাঃ অধিকারী বললেন।
সে কি!
হ্যাঁ, হি ইজ নো মোর! ইন্সট্যানটেনিয়াস ডেথ হয়েছে বিজনের!
কিরীটীও যেন ডাঃ বাসুদেব অধিকারীর কথায় স্তব্ধবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল ক্ষণেকের জন্য, কিন্তু পরক্ষণেই সে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে নিচু হয়ে মেঝের কার্পেট থেকে কাপটা তুলে নিতে গিয়ে দেখল, কিছুক্ষণ পূর্বে তাদের সকলের দৃষ্টির সামনে মেঝেতে বিজনের হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল যে কাপটা-ইতিমধ্যে বিজনের সোফার তলায় চলে গিয়েছে। কোন্ এক সময়।
কারও পায়ের ধাক্কায় বোধ হয় কাপটা সোফার নিচে চলে গিয়েছিল।
কিরীটী সোফার নিচে হাত ঢুকিয়ে কাপটা তুলে নিল।
কাঁচের কাপের গায়ে তখন চা লেগে রয়েছে।
ডাঃ অধিকারীর উচ্চারিত কথাটা যেন ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলকেই একেবারে বোবা করে দিয়েছিল।
মৃদুকণ্ঠে কিরীটী যেন কতকটা আত্মগত ভাবেই বললে, এমন আকস্মিক মৃত্যু—
শচীবিলাস বললেন, হঠাৎ এভাবে হার্টফেল করলেন, কোন অসুখ-বিসুখ ছিল নাকি ভদ্রলোকের মিঃ সরকার?
বৃন্দাবন অসহায় ভাবে মাথা নেড়ে বললেন, কই, সেরকম কিছু রোগ ওর ছিল বলে তো শুনিনি!
আকস্মিক হার্টফেল বলেই কি আপনার মনে হয়, ডাঃ অধিকারী? সহসা কিরীটী ডাঃ অধিকারীর দিকে চেয়ে প্রশ্নটা করল।
য়্যাঁ!
বলছিলাম পয়েজনিং নয় তো? কিরীটী আবার বলে।
পয়েজনিং! বিস্মিত ডাঃ অধিকারী এবারে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, নিকোটিন পয়েজনিং নয় তো?
নিকোটিন পয়েজনিং!
একটা অভিশপ্ত চাপা কান্নার মতই যেন মৃদুচ্চারিত বৃন্দাবনবাবুর কথাটা ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলকে একটা বৈদ্যুতিক শক দেয় অকস্মাৎ।
হ্যাঁ, একান্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে বাধ্য হচ্ছি আমি, এটাও বোধ হয় হত্যা। কিরীটী আবার বললে।
হত্যা! কি বলছেন মিঃ রায়? প্রশ্নটা করলেন মধুসূদন সরকার এবারে।
মনে তো হচ্ছে তাই। তবে ময়না তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত অবিশ্যি কিছু ডেফিনিট বলা যাচ্ছে না। তবু মধুসূদনবাবু, আপনি এখুনি একবার থানার বিমলবাবুকে খবর দিন।
আরও ঘণ্টাখানেক পরে। সংবাদ পেয়েই বিমলবাবু ছুটে এসেছে।
বিমল সব শুনে বলে, তাহলে আপনার ধারণা মিঃ রায়, ইটস এ সিমিলার কেস!
আমার তো তাই বলেই মনে হচ্ছে। এই কাপটা একবার অ্যানালিসিস করতে পাঠাতে পারেন?
তবে আমার মনে হয়—
কি?
এবারও হয়ত পূর্বের মতই অ্যানালিসিস করেও কিছুই পাবেন না ওতে।