তাই বলে একটা খোঁড়া কুৎসিত চাকর–
চাকরই বটে। যাক সে কথা। তবে একটা ব্যাপার, আপনার চোখ স্বচ্ছ থাকলে আপনিও দেখতে পেতেন কিছু।
কি?
আজ সকালে শকুন্তলা দেবীর ঘরে—
শকুন্তলা দেবীর ঘরে—কি?
সদ্য-প্রস্ফুটিত গোলাপের গুচ্ছ ও ধূপের প্রজ্বলন্ত কাঠি।
মানে?
মানে সব-সবটাই অভিনয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, কার সঙ্গে অভিনয় এবং কেনই বা ঐ অভিনয়টা করলেন শ্ৰীমতী?
মিঃ রায়!
তাই বলছিলাম সুশান্তবাবু, আপনার বয়েসটা বড় risky! ও কেয়ার ঝোপ-গন্ধে মাতাল হয়ে হুট করে হাত বাড়াবেন না-জানেন তো কেয়ার ঝোপের আশেপাশেই আত্মগোপন করে থাকে কালনাগ!
বিস্মিত দৃষ্টি তুলে সুশান্ত আবার অন্ধকারেই পথ চলতে চলতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিন্তু অন্ধকারে কিরীটীর মুখটা ভাল করে তার নজরে পড়ে না।
সুশান্তর মনে হয়, কিরীটী যেন রীতিমত হেঁয়ালি করে কথা বলছে। তাই একসময় সে প্রশ্ন করে, আপনি যেন বড্ড হেঁয়ালি করে কথা বলছেন মিঃ রায়।
হেঁয়ালি নয়, সুশান্তবাবু। সহজ সত্যি কথাগুলোই বলছি। এবং আজকের এই হত্যারহস্যের আসল সত্যটা যেদিন আপনার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে, দেখবেন মিলিয়ে—আজ যা বলছি মিথ্যা বা অতিশয়োক্তি নয় এর কিছুই। কিন্তু বাড়ির কাছে এসে পড়েছি—চলুন চায়ের পিপাসায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠেছে। এক কাপ চায়ের প্রয়োজন বর্তমানে সবচাইতে বেশী।
রাত্রে খাবার টেবিলে বসেও আবার সরকার ভিলার মৃত্যু-রহস্যের আলোচনাতেই ফিরে যায় ওরা।
কিরীটী একসময় কথায় কথায় বলে, সারদাবাবুর উইলটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে।
জানবেন। তার এই রহস্যজনক হত্যার ব্যাপারে আমার যতদূর ধারণা
উইল তোবোধ হয় কাল-পরশুর মধ্যেই পড়া হবে!
হ্যাঁ—আর উইলের মর্মকথাটা একান্তভাবেই জানা দরকার।
উইল খোলা হলেই তা জানতে পারবেন।
তা জানতে পারব, তবে সে সময় আমি উপস্থিত থাকতে চাই–
সে আর এমন কঠিন ব্যাপার কি? মধুসূদনবাবুকে আপনি বললেই হয়তো রাজী হবেন তিনি।
কাল সকালেই সরকার ভিলায় একবার গিয়ে অনুরোধটা তাকে জানাব ভাবছি।
বেশ তো।
পরের দিন সকালেই কিরীটী সরকার ভিলায় গেল।
বাইরের ঘরে মধুসূদনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কিরীটীর।
মধুসূদন ও শকুন্তলা বসে প্রভাতী চা-পান করছিলেন।
এই যে মিঃ রায়, আসুন আসুন-একেবারে সকালেই যে! কোন মীমাংসায় পৌঁছতে পারলেন নাকি? মধুসূদন আহ্বান জানালেন।
না, ব্যাপারটা বড় জটিল বলে মনে হচ্ছে-বলতে বলতে তির্যক দৃষ্টিতে একবার তাকালো কিরীটী মধুসূদনের মুখোমুখি উপবিষ্ট শকুন্তলার দিকে।
তাহলে এখনও কিছু বুঝতে পারেননি?
না। কিন্তু একটা request ছিল—
বলুন?
আপনার কাকার উইল কবে পড়া হচ্ছে?
বোধ হয় তো কালই, কিন্তু কেন বলুন তো?
আমি যদি সে-সময় উপস্থিত থাকি, আপত্তি হবে আপনার?
বিলক্ষণ, আপত্তি কিসের! নিশ্চয়ই থাকবেন।
তাহলে সেই কথাই রইল। আপনি আমাকে একটা খবর পাঠাবেন।
নিশ্চয়ই। কিন্তু এক কাপ চা খাবেন না?
না, এখন একবার থানায় বিমলবাবুর ওখানে যাব ভাবছি। কাল তার ওখানে গিয়ে দেখি উনি থানায় নেই!
বেশ।
কিরীটী সরকার ভিলা থেকে অতঃপর বের হয়ে এল।
১৮. বৃন্দাবন সরকার ইচ্ছা করে
বৃন্দাবন সরকার ইচ্ছা করে ভাগ্নে বিজনকে সরকার ভিলায় আমন্ত্রণ করে আনেননি জরুরী চিঠি দিয়ে।
মৃত সারদাচরণের নির্দেশমতই বিজনকে আসার জন্য তাঁকে চিঠি দিতে হয়েছিল। এবং শুধু বিজনকেই নয়, আরও দুজন ভদ্রলোকও পরের দিন বৃন্দাবন সরকারের সঙ্গে কলকাতা হতে এলেন ঐ উইলের নির্দেশমতই।
একজন সারদাচরণের বিশেষ পরিচিত বাল্যবন্ধু ডাঃ বাসুদেব অধিকারী, অন্যজন সারদাচরণের আত্মীয় অর্থাৎ সারদাচরণের ভগ্নীপতি রতিকান্ত মল্লিক।
ডাঃ অধিকারী ও রতিকান্ত মল্লিক দুজনেরই বয়স হয়েছে, প্রৌঢ়।
সলিসিটার শচীবিলাস বসুও এলেন ওঁদের সঙ্গে।
চল্লিশের ঊর্ধ্বে বয়স হয়েছে শচীবিলাসের।
পরের দিন শুক্রবার সকলে এসে বিকেল পাঁচটা নাগাদ সরকার ভিলার লাইব্রেরী ঘরে জমায়েত হলেন।
মধুসূদন সরকার, বৃন্দাবন সরকার, বিজন, ডাঃ বাসুদেব অধিকারী, রতিকান্ত মল্লিক ও কিরীটী রায়।
মাঝখানে বসলেন সলিসিটার শচীবিলাস এবং তাকে ঘিরে বসলেন অন্যান্য সকলে।
সকলের উপস্থিতিতেই শচীবিলাস তাঁর ফোলিও থেকে একটি সিল-করা পুরু লেপাফা বের করলেন ও সিল ভেঙে সারদাচরণের শেষ উইলটি বের করলেন।
উইলের সারমর্ম শুনে কিরীটী রীতিমত অবাক হয়ে যায়।
বিরাট সম্পত্তির মালিক ছিলেন সারদাচরণ সরকার।
স্থাবর, অস্থাবর, ব্যবসা ও নানা ধরনের সম্পত্তি মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি।
এবং সেই সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারার যে নির্দেশ তিনি দিয়ে গিয়েছেন তা হচ্ছে এইরূপঃ
কলকাতা, বোম্বাই ও দিল্লীর জুয়েলারী ব্যবসার দুইয়ের তিন অংশ দিয়ে গিয়েছেন তিনি বৃন্দাবন সরকারকে এবং বাকি একের তিন অংশ নিরুদ্দিষ্ট মধুসূদন সরকারকে।
কলকাতার বাড়িটা দিয়েছেন বিজনকে। সরকার ভিলা দিয়েছেন শকুন্তলা দেবীকে জীবনস্বত্বে। ব্যাঙ্কের নগদ এক লক্ষ টাকা সমান ভাগে অর্ধেক দিয়েছেন ডাঃ বাসুদেব অধিকারী ও রতিকান্ত মল্লিকের হাতে একটি দাতব্য হাসপাতাল তৈরীর জন্য—তার মৃত জ্যেষ্ঠ রণদাচরণের স্মৃতিরক্ষার্থে এবং বাকী অর্ধেক সমান ভাগে বৃন্দাবনের কন্যাকে এবং বিজনকে। মধুসূদন যদি জীবিত না থাকে, তার অংশ সব পাবে বৃন্দাবন।