সত্যিই তাই। কে যেন সর্বক্ষণ এখানে চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরছে আমাকে।
আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, সকালে তখন একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করব-করব করে করা হয়ে ওঠেনি!
কি?
সারদাবাবু বেশ সৌখীন প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাই না?
কেন বলুন তো? হঠাৎ এ কথা আপনার মনে উদয় হল কেন?
উদয় হল কেন সে কথা নাই বা শুনলেন, কথাটা সত্য কি মিথ্যা সেটাই শুধু জিজ্ঞাসা করছি।
মুহূর্তকাল শকুন্তলা চুপ করে যেন কি ভাবতে থাকে।
অস্পষ্ট আলো-ছায়ায় কিরীটী শকুন্তলার মুখের কোন ভাবান্তর বুঝতে পারে না।
তৎসত্ত্বেও সে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে শকুলার মুখের দিকে।
মৃদুকণ্ঠে শকুন্তলা বলে, আপনার অনুমান সত্যি কি মিথ্যা তা জানি না মিঃ রায়, কারণ এখানে আসা অবধি দু মাস পর্যন্ত যাঁকে অত্যন্ত সংযমী ও কোন বিলাস-ব্যসন যাঁর নেই। বলেই মনে হয়েছিল এবং ব্যবহারেও দেখেছি, সেই লোক বলেন, আসা অবধি দু মাল আপনার অনুমন সন্ত মুখে–
ধীরে ধীরে যেন বদলে গিয়েছিলেন, তাই না? কিরীটাই শকুন্তলার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে শেষ করে।
হ্যাঁ।
কিন্তু তার কোন কারণই আপনি বুঝতে পারেননি?
না।
তাঁর কথায়বার্তায় হাবভাবে কখনও কিছু প্রকাশ হতেও দেখেননি যাতে করে তার ঐ পরিবর্তনটা—কারণ আপনি তো সব সময়ই প্রায় তার কাছে-কাছেই থাকতেন–
না, তবে একটা ব্যাপার ইদানীং মাস দুই থেকে লক্ষ্য করছিলাম—
কি?
আগে আগে ইতিহাস ও ধর্মগ্রন্থই বেশীর ভাগ তাঁকে পড়ে শোনাতে হত আমাকে, কিন্তু ইদানীং প্রায় বৈষ্ণব কাব্য থেকেই কেবল আমাকে পড়ে শোনাতে বলতেন।
তাতেও বোঝেননি ব্যাপারটা? মৃদু হেসে কিরীটী কথা বললে।
কিরীটীর কথায় যেন একটু বিস্মিত হয়েই তাকায় শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে, তারপরই হঠাৎ বলে, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! ইজ ইট পসি?
ঠিক তাই শকুন্তলা দেবী। আপনার মত বুদ্ধিমতী মেয়ের আগেই কিন্তু ব্যাপারটা বোঝ উচিত ছিল তার ড্রয়ারের ভিতরকার বিশেষ দ্রব্যগুলো দেখে।
বিশেষ দ্রব্যগুলো?
হ্যাঁ, পাউডার, সেন্ট, কলপ ইত্যাদি-সৌখীন দ্রব্যগুলি নিশ্চয়ই আপনার চোখের দৃষ্টি এড়ায়নি—কারণ আপনি যখন তার ড্রয়ার খুলতেন মধ্যে মধ্যে। আমার তো মনে হয় তার ইদানীং ইনসমনিয়াটা যে বেড়ে গিয়েছিল তারও কারণ ঐ–
শকুন্তলা এবারে আর কোন জবাব দেয় না।
চুপ করেই থাকে।
মানুষের মন এমনিই বিচিত্র বটে শকুন্তলা দেবী! কিরীটী আবার বলতে থাকে, নইলে সারদাবাবুর যে বয়স ছিল সে বয়সে তো অমনটা ঘটা উচিত ছিল না। আর আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে তো খুব সম্ভব–
কিরীটী তার কথা শেষ করতে পারে না।
তার আগেই যেন চমকে শকুন্তলা প্রদোষের অন্ধকারে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কি, কি মিঃ রায়?
যা শকুন্তলা দেবী, পঞ্চশরের ঐ অকাল শরক্ষেপই সম্ভবত তার আকস্মিক মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।
তার মানে?
মানেটা মনে মনে চিন্তা করে দেখলে আপনিও হয়তো বুঝতে পারবেন, আমার ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া—
কিরীটীর কথাটা শেষ হল না, অদুরে পদশব্দ পাওয়া গেল এবং সুশান্তর গলা শোনা
গেল, মিঃ রায়?
কে! সুশান্তবাবু, আসুন—আমরা এখানে। শকুন্তলা দেবী, সুশান্তবাবু এসেছেন।
শকুন্তলা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলে, চলুন ঘরে যাওয়া যাক। বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।
কোথায় ছিলেন এতক্ষণ সুশান্তবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করে।
আমার সঙ্গে গল্প করছিলেন। জবাব এল সুশান্তর ঠিক পশ্চাতেই মধুসূদনের কণ্ঠ থেকে অন্ধকারে।
কে, মধুসূদনবাবু! কিরীটী ঘুরে দাঁড়ালো যেন সঙ্গে সঙ্গেই।
কাকার বাগানটা দেখলেন? মদুসূদন আবার প্রশ্ন করলেন একটু এগিয়ে এসে।
হ্যাঁ, দেখলাম। সত্যিই চমৎকার।
কত টাকা যে এর পিছনে ঢেলেছেন কাকা। কিন্তু এখানে আর নয়। চলুন ঘরে যাওয়া যাক।
কিন্তু এখন আর ঘরে যাব না মিঃ সরকার। একবার বিমলবাবুর ওখানে যেতে হবে, কিরীটী বলে।
বেশ তো যাবেনখন। এক কাপ চা খেয়ে যাবেন।
তা মন্দ নয়, চলুন—
সকলেই অন্ধকারেই অগ্রসর হয়।
১৫. আমাকে অনুসরণ করে আসুন
আমাকে অনুসরণ করে আসুন মিঃ রায়। মদুসূদন সরকার বললেন, আপনারা পথ ঠিক হয়তো চিনতে পারবেন না। আর একটু সাবধানে আসবেন, যা চারিদিকে ঝোপ-ঝাড় বলা যায় না কিছু!
কেন, এখানে সাপ আছে নাকি? কিরীটী প্রশ্ন করে চলতে চলতেই অন্ধকারে।
খুব কি বিচিত্র নাকি কথাটা! মৃদু হেসে মধুসূদন সরকার কথাটা বললেন, চারিদিকে যা বনজঙ্গল করে গিয়েছেন এখানে কাকা, তা আচমকা একটা বাঘ বেরুলেও আশ্চর্য হবে না বোধ হয় কেউ।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, কথাটা কিন্তু একটু অতিশয়োক্তিই হল মধুসূদনবাবু আপনার।
কেন বলুন তো?
তা বৈকি। এরকম জায়গায় সাপই অতর্কিতে ছোবল বসাতে পারে, কিন্তু এখানে বাঘের আসাতে তার রক্তের আভিজাত্যে বাধবে। কিরীটী চলতে চলতেই হেসে জবাব দেয়।
শকুন্তলা আর সুশান্ত কিন্তু নিঃশব্দেই পথ অতিক্রম করছিল।
এবং কিরীটী লক্ষ্য করে তারা যেন পরস্পরের সঙ্গে একটু ঘেঁষাঘেঁষি করেই পথ চলছিল।
বারান্দার গেটের কাছাকাছি এসে সহসা আবার কিরীটী বলে, মিথ্যে বলেননি আপনি মিঃ সরকার। সত্যি আপনি সঙ্গে না থাকলে এমন অবলীলাক্রমে কিন্তু এখানে এসে পৌঁছতে পারতাম না এখন বুঝতে পারছি। তা আপনারও বুঝি শকুন্তলা দেবীর মত কাকার বাগানটা ভাল লেগে গিয়েছে?
ক্ষেপেছেন মশাই! বনজঙ্গল আমার একদম ধাতে সয় না। তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ জানিয়ে বলে ওঠেন মধুসূদন সরকার।