বর্মা চুরুটের পরিচিত গন্ধ। কিরীটীর ভুল হবার নয়।
এদিক ওদিক তাকাতেই অল্প দূরে ঘাসের ওপর একটি নিঃশেষিত-প্রায় বর্মা চুরুট এবারে ওর নজর পড়ে।
মৃদু হেসে মুহূর্তকাল কিরীটী আপন মনে যেন কি ভাবে। তারপর মৃদুকণ্ঠে ডাকে, শকুন্তলা দেবী।
কে?
চমকে ফিরে তাকাতেই শকুন্তলা সামনেই দণ্ডায়মান কিরীটীকে দেখতে পেয়ে একটু যেন বিস্মিত হয়েই প্রশ্ন করে, এ কি, আপনি!
হ্যাঁ। সারদাবাবুর বাগানটা ঘুরে দেখতে দেখতে এদিকে আসতেই লক্ষ্য করলাম, আপনি চুপচাপ বসে আছেন।
হ্যাঁ, এই নির্জন জায়গাটি বাগানের মধ্যে আমার খুব ভাল লাগে, তাই বিকেলের দিকে এখানে এসে প্রায়ই বসি।
যা বলেছেন, সত্যই চমৎকার জায়গাটি! কিন্তু মধুসূদনবাবুকে দেখছি না যে? তিনি কোথায়?
কিরীটীর শেষের কথায় যেন একটু চমকেই শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল এবং অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে উচ্চারণ করল, মধুসুদনবাবু।
হ্যাঁ, ঐ যে গোকুল বলল, তিনি নাকি বাগানেই আছেন?
তা—তা হবে। আমি তো দেখিনি।
তাহলে বোধ হয় অন্যদিকে কোথাও আছেন! হা ভাল কথা, বৃন্দাবনবাবুর আজ কলকাতায় ফিরে যাবার কথা ছিল, গেছেন নাকি চলে তিনি কলকাতায়?
হ্যাঁ, বিকেলের ট্রেনেই চলে গেলেন।
আপনার নির্জন বিশ্রামে ব্যাঘাত করছি না তো শকুন্তলা দেবী?
না, না-ব্যাঘাত কিসের আবার! আপনি বুঝি একলাই এসেছেন?
কেন বলুন তো?
না—এমনিই জিজ্ঞাসা করছিলাম।
১২. সরকার-ভিলা থেকে বের হয়ে
সরকার-ভিলা থেকে বের হয়ে কিরীটী আর সুশান্ত দুজনে মণি লজের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
বাইরে রৌদ্রের তাপ বেশ প্রখর হয়ে উঠেছে তখন।
পথে দুজনার মধ্যে আর বিশেষ কোন কথাবার্তা হয় না।
দ্বিপ্রহরে আহারাদির পর পাশাপাশি বিনয় ও সুশান্ত একটা সোফায় বসে এবং কিরীটী তাদের অল্প ব্যবধানে অন্য একটি সোফায় বসে সরকার-ভিলার হত্যা-ব্যাপার সম্পর্কেই পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করছিল।
সহসা একসময় সুশান্ত প্রশ্ন করে, আপনার কথায় মনে হচ্ছে মিঃ রায়, বৃন্দাবন সরকারকেই আপনি যেন একটু বেশী সন্দেহ করছেন।
সন্দেহ কাউকেই ও-বাড়ির আমি কম বেশী করছি না সুশান্তবাবু, কিরীটী হস্তধৃত পাইপটায় মৃদু একটা টান দিয়ে খানিকটা পীতাভ ধোঁয়া উদগিরণ করে বলতে থাকে, আপনাকে তো একটু আগেই বললাম, সারদাচরণ সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারটা রীতিমত জটিল। জানবেন, কবি আমাদের মিথ্যে বলেননি, পঞ্চশরে দন্ধ করে করেছে এ কি সন্ন্যাসী, বিশ্বময় দিয়েছো তারে ছড়ায়ে। পঞ্চশরের এমনই প্রতাপ যে কোন গতিই সে মানতে রাজী নয়। এই দেখুন না-আপনার কথাটাই ধরুন।
বিস্ময়ে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে সুশান্ত প্রশ্ন করে, আমার কথা?
হ্যাঁ, শকুন্তলার প্রতি আপনার দুটি চক্ষুর নীরব মুগ্ধ দৃষ্টি আপনার মনশ্চক্ষে ধরা পড়ার কথা নয় অবিশ্যি, কিন্তু আমার ও শকুন্তলা দেবীর দৃষ্টিকে এড়ায়নি। মৃদু রহস্য-তরল কণ্ঠে কিরীটী কথাগুলো বলে।
কিরীটীর অতর্কিত আক্রমণে সুশান্তর মুখখানা সহসা রক্তিম হয়ে ওঠে এবং মৃদু লজ্জাজড়িত কণ্ঠে বলে, কি যে আপনি বলেন মিঃ রায়!
মৃদু হেসে সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী জবাব দেয়, না, না—এতে তো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। সুশান্তবাবু। শকুন্তলার ইতিহাস যাই হোক না কেন, মুখখানি তার সত্যিই সুন্দর। আর সুন্দর বস্তুর প্রতি বিশেষ করে সে যদি আবার সজীব হয় তো তার প্রতি মানুষ মাত্রের আকর্ষণ তো একান্তই স্বাভাবিক।
বিনয় হো হো করে হেসে ওঠে, কিরীটীর কথায়।
সুশান্ত ঐসময় তাড়াতাড়ি কথার মোড়টা ঘুরিয়ে দেবার জন্য বলে ওঠে, কিন্তু সরকারভিলার ল্যাবরেটারী থেকে ঐসময় আমাকে রোজ স্পেয়িং সলুশন-এর শিশিটা সরিয়ে আনতে বললেন কেন মিঃ রায় এখনও বুঝতে পারছি না।
ব্যস্ত কি, সময়ে সব জানতে পারবেন। কিন্তু শিশিটা কোথায় রেখেছেন?
রেখে দিয়েছি আমার ঘরে। সাবধানে রেখেছেন তো?
হ্যাঁ।
দেখবেন সাংঘাতিক বিষ!
বিষ!
হ্যাঁ, কিন্তু যাক এখন নিশ্চিন্ত। ভাল কথা, শিশিটা যখন সরিয়ে নিয়ে আসেন কেউ আপনাকে দেখেনি তো?
না।
মধুসূদনবাবু তখন কোথায় ছিলেন?
দেখিনি।
শকুন্তলা দেবী?
জানি না, লক্ষ্য করিনি।
তার ঘরের দরজার দিকে যাবার সময় বারান্দা দিয়ে তাকানও নি?
না।
১৪. শকুন্তলার মুখের দিকে তাকিয়ে
শকুন্তলার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে কিরীটী এবারে বলে, না, একা আসিনি, আমার সকালের সেই বন্ধুটিও এসেছেন। ওদিককার গোলাপ বাগিচার দিকে গেলেন গোলাপ দেখতে এইমাত্র।
নিজের অনুমানটা যে মিথ্যা নয় বুঝতে পেরে কিরীটী মনে মনে একটু যেন উল্লসিতই হয়। কিন্তু চোখেমুখে তার সে ভাবটা প্রকাশ পায় না।
কিন্তু পরক্ষণেই শকুন্তলার কণ্ঠস্বরে কিরীটীর চিন্তায় ছেদ পড়ে। .
দাঁড়িয়ে কেন মিঃ রায়, জায়গাটা বেশ পরিষ্কার-বসুন না!
কিরীটী আর দ্বিধামাত্রও না করে শকুন্তলার অল্প ব্যবধানে ঘাসের উপরেই বসে পড়ল।
ক্রমশ অস্পষ্ট আলোয় চারিদিক আরও বিষণ্ণ আরও ধূসর হয়ে আসছে যেন তখন।
কিরীটীই অতঃপর একসময় কথা শুরু করে, সারদাবাবুর মৃত্যুতে আপনি শোক পেয়েছেন শকুন্তলা দেবী, তাই না?
উনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মাত্র আট মাস তার কাছে কাজ করেছি, কিন্তু তার ব্যবহার কখনও ভুলতে পারব না বোধ হয় মিঃ রায় এ জীবনে।
স্বাভাবিক। এক-একজন আছেন যারা খুব সামান্য সময়ের মধ্যেই দূরের জনকে কাছে টেনে নেন। আর তাইতেই নিশ্চয়ই আপনি এ জায়গার মায়া এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।