কিরীটী অতঃপর লিখবার টেবিলের সামনেই সর্বপ্রথম এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল ও টেবিলের সাইডে যে ড্রয়ার ছিল তার সবার উপরের ড্রয়ারটা টানতেই সেটা বের হয়ে এল।
ড্রয়ারটা ভর্তি নানা টুকিটাকি জিনিসপত্রে। একটা মোটা ডাইরী কালো রংয়ের মলাটের, গোটা দুই ঝর্ণা কলম, একটা শেফিল্ডের ছুরি, একটা জেমস পকেট ডিক্সনারী, কোরামিনের একটা ফাইল ও একটা লুমিনল ট্যাবলেটের টিউব।
এটা-ওটা নাড়াচাড়া করতে করতে কিরীটী লুমিনল ট্যাবেলেটের টিউবটা তুলে নিল ড্রয়ার থেকে।
একেবারে আনকোরা টিউব। মুখ খোলাই হয়নি তখনও। কুড়িটা ট্যাবলেটই রয়েছে।
কি ভেবে কিরীটী টিউবটা নিজের পরিধেয় কোটের পকেটে রেখে দিল।
তারপর কালো মলাটের ডাইরীটা তুলে নিল ড্রয়ার থেকে।
অন্যমনস্ক ভাবে ডাইরীর পাতা উল্টে উল্টে দেখতে লাগল। কিছু নাম ও ঠিকানা লেখা। মধ্যে মধ্যে টাকার হিসাব লেখা এবং শেষের দিকে এক জায়গায় দেখল লেখা আছে-গাছের নানা প্রকারের সারের কথা।
তারই এক জায়গায় বিশেষভাবে তার দৃষ্টি যেন আকৃষ্ট হল। সেখানে লেখা : এককালে আমেরিকায় একপ্রকার স্থানীয় উদ্ভিদের নাম ছিল নিকোটিয়ানা, এখন অবিশ্যি ভারতবর্ষে নাকি ঐজাতীয় উদ্ভিদ প্রচুর আছে। নিকোটিয়ানা থেকে দুই প্রকারের অ্যালকলয়েড পাওয়া। যায়। নিকোটিন ও নিকোটিনাইন। ঐ নিকোটিনে খুব ভাল গাছের সার হয় যদিও ওটা তীব্র বিষ। মাত্র দুতিন ফেঁটা নিকোটিন বিষই মারাত্মক—মাত্র দুতিন মিনিটের মধ্যে মৃত্যুই ঘটতে পারে। পিওর বা খাঁটি নিকোটিন অ্যালকলয়েডের কোন রং নেই, জলের মতই সাদা।
ঐ পর্যন্তই। আর কিছু লেখা নেই ঐ পৃষ্ঠায়।
আবার কিরীটী পাতা উল্টে যায় ডাইরীর।
সহসা আবার এক পাতায় দৃষ্টি স্থিরনিবদ্ধ হয় একটি লাইনের উপর।
নতুন সারটার নাম দিলাম : রোজ প্রেয়িং সলুশন।
সুশান্তবাবু?
সুশান্তর দিকে ফিরে সহসা কিরীটী ডাকল।
কিছু বলছিলেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ, শুনুন—বলে সুশান্তর কানের কাছে মুখ নিয়ে কিরীটী নিম্নকণ্ঠে যেন কি বললে তাকে। পরমুহূর্তেই সুশান্ত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী ডাইরীটাও পকেটস্থ করল।
এবারে কিরীটী দ্বিতীয় ড্রয়ারটা টেনে খুলল। কিন্তু দ্বিতীয় ড্রয়ারটি টেনে খুলেই যেন কিরীটীর মনে বিস্ময়ের একটা চমক লাগে।
টুকিটাকি সব প্রসাধন দ্রব্য ড্রয়ারের মধ্যে রয়েছে। পাউডার, সেন্ট,-দামী ইভনিং প্যারি সেন্ট, ছোট একটি সুদৃশ্য আয়না। একটি চিরুনি, একটি চুল ভোলার সন্না, ছোট একটি কাঁচি, একটি দামী কলপের শিশি। ঐসব ছাড়াও এক টিন ৯৯৯ সিগারেট ও একটি দেশলাই। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে ঐ জিনিসগুলোর দিকে চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে একসময় আবার কিরীটী নিঃশব্দে ড্রয়ারটা বন্ধ করে দিল। এবং অদূরে নিঃশব্দে দণ্ডায়মান বৃন্দাবনবাবুর দিকে ফিরে তাকাল।
বৃন্দাবনবাবু!
বলুন?
আপনার কাকাবাবু একটু বেশ শৌখীন প্রকৃতির ছিলেন, তাই না?
না তো! তবে ইদানীং—বলতে গিয়েও থেমে যান বৃন্দাবন সরকার, যেন কেমন একটু ইতস্ততঃ করেন।
কি? থামলেন যে?
না, তেমন বিশেষ কিছু নয়। তবে ইদানীং মাসখানেক ধরে যেন একটু মনে হয়েছে নিজের সাজসজ্জার প্রতি তার একটু নজর পড়েছিল। নচেৎ বরাবরই তো জ্ঞান হওয়া অবধি দেখে এসেছি অত্যন্ত সিম্পল, বিলাসিতাকে ঘৃণাই করতেন। বেশভূষা কিছুতেই কোন নজর কোনদিনই ছিল না।
হুঁ। আচ্ছা আপনার কি মনে হয় বৃন্দাবনবাবু, ইদানীং তার ঐ পরিবর্তনের কোন কারণ ঘটেছিল?
প্রশ্নটা করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবার তাকাল কিরীটী বৃন্দাবন সরকারের মুখের দিকে। এবং কিরীটীর ঐ স্পষ্টাস্পষ্টি প্রশ্নে বৃন্দাবন সরকার যে সহসা একটু বিব্রত হয়ে পড়েছেন সেটা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে কিরীটীর কষ্ট হয় না। মনে মনে তার অতি দুঃখে হাসি এলেও, বাইরে কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না।
না, মানে, আমি ঠিক বলতে পারব না মিঃ রায়! একটু যেন থেমে থেমে কথাগুলো কোনমতে উচ্চারণ করেন বৃন্দাবন সরকার। ( ঠিক ঐ মুহূর্তে সুশান্ত এসে পুনরায় ঘরে প্রবেশ করলে। এবং কিরীটীর দিকে তাকাতেই
পরস্পরের চোখে চোখে কি যেন কথা হল নিঃশব্দে।
কিরীটী এবারে সর্বশেষ ড্রয়ারটি টেনে খুললে। কিন্তু তার মধ্যে বিশেষ কোন দ্রষ্টব্য বস্তু তার চোখে পড়ল না।
বেলাও ইতিমধ্যে প্রায় সাড়ে দশটা হয়ে গিয়েছিল।
বৃন্দাবন সরকারের দিকে চেয়ে কিরীটী বললে, চলুন মিঃ সরকার, এ-ঘরে আর আমার দেখবার কিছু নেই।
অন্য ঘরগুলো দেখবেন না? বৃন্দাবন সরকার প্রশ্ন করেন।
এখন আর নয়। বিকেলের দিকে এসে আপনাদের বাগানটা একবার দেখব, কিরীটী বলে।
বেশ তো আসবেন। তবে আজই আমি কলকাতায় চলে যাচ্ছি দুপুরের ট্রেনে মিঃ রায়। আজই যাবেন?
হ্যাঁ, দাদা বোধ হয় এখানেই থাকছেন। আপনার যা প্রয়োজন ওঁকেই বলবেন। কাকার মৃত্যুর পর কলকাতায় তো আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। দোকানের হিসাবপত্রও সব একবার দেখা দরকার।
তা তো নিশ্চয়ই। তা কবে ফিরছেন?
তা ঠিক বলতে পারছি না। তবে হপ্তাখানেকের আগে ফিরতে পারব মনে হয় না।
১২. একটা কথা জিজ্ঞাসা করব
একটা কথা জিজ্ঞাসা করব মিঃ রায়? সুশান্ত সহসা প্রশ্ন করে।
নিশ্চয়ই।
আপনার সন্দেহের তালিকার মধ্যে–
সুশান্তর কথাটা তাকে শেষ না করতে দিয়ে কিরীটী বলে ওঠে, শকুন্তলাও আছেন কিনা, এই তো আপনার প্রশ্ন সুশান্তবাবু? দুঃখের বিষয়, আছেন। কি জানেন সুশান্তবাবু, ক্রিমিন্যাল মাইনডেড়দের মুখের একটা-না-একটা বিশেষত্ব নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন যদি সেই মুখগুলোর দিকে একটু ভাল করে চেয়ে দেখেন!