প্রত্যুত্তরে কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর আবার তার প্রশ্ন শুরু করে, আপনি শুনলাম অনেক দিন নাকি বর্ষায় ছিলেন, তাই কি শকুন্তলা দেবী?
হ্যাঁ।
বর্মায় কোথায় ছিলেন?
দ্বিতীয়বার তখনি শকুন্তলা আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তকণ্ঠে প্রশ্ন করল, বর্মায় আপনি গিয়েছেন নাকি কখনও মিঃ রায়?
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, হ্যাঁ, সেইজন্য বর্মা দেশের প্রায় সব কিছুই মোটামুটি আমার জানা।
রেঙ্গুনে। মাথাটা নিচু করে শকুন্তলা অতঃপর বললে।
প্রপার রেঙ্গুন শহরেই বরাবর ছিলেন?
হ্যাঁ।
ভাল কথা শকুন্তলা দেবী, সারদাবাবুর যে হার্টের ট্রাবলস ছিল, আপনি তো তা জানতেন?
জানতাম।
মধ্যে মধ্যে তিনি ইনসমনিয়ার জন্য আবার ঘুমের ঔষধ খেতেন, তাও আপনি জানতেন?
জানতাম।
আচ্ছা যে রাত্রে সারদাবাবু মারা যান, সেরাত্রে কখন আপনার সঙ্গে সারদাবাবুর শেষ দেখা হয় ও তার সঙ্গে আপনার শেষ কথাবার্তা হয়?
ঠিক মনে নেই, তবে রাত প্রায় সাড়ে নটা পর্যন্ত আমরা লাইব্রেরী ঘরেই ছিলাম। ওঁকে আমি বই পড়ে শোনাচ্ছিলাম। ঐসময় বৃন্দাবনবাবু ওঁর সঙ্গে কি জরুরী কথাবার্তা বলতে আসায় আমাকে ছুটি দিয়ে ওঁরা মিঃ সরকারের ঘরের দিকেই যান।
তাদের মধ্যে তাহলে সেরাত্রে কি ধরনের কথাবার্তা হয়, আপনি কিছুই জানেন না? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
না।
কিন্তু আমি যতদূর শুনেছি, আপনি নাকি ঐ রাত্রেই রাত এগারোটা নাগাদ আবার সারদাবাবুর ঘরে গিয়েছিলেন, কথাটা কি সত্যি?
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ঐ সময় তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন আবার তার ঘরে।
অত রাত্রে?
হ্যাঁ, লুমিনলের ফাইলটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
আপনি বুঝি মধ্যে মধ্যে তাকে ঔষধপত্রও দিতেন?
দিতাম।
হুঁ, তারপর আপনি কি করলেন?
ঔষধের ফাইলটা খুঁজে দিয়ে যখন চলে আসছি আমাকে বললেন, দশরথকে এক কাপ চা তাকে দিয়ে যেতে বলবার জন্য।
বলেছিলেন আপনি সেকথা দশরথকে?
হুঁ–আমি বলিনি, তবে গোকুলকে দিয়ে বলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
আচ্ছা সে সময় সারদাবাবুর মুড আপনার কি রকম লেগেছিল?
কেন, হি ওয়াজ পারফেক্টলি অল রাইট, নাথিং অ্যাবনরমাল আই ফাউণ্ড দেয়ার!
আই সি! আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, এ বাড়িতে সারদাবাবুর মৃত্যুর কয়েক দিন আগে কেতু নামে কে একজন লোককে কাজে বহাল করা হয়েছিল এবং যার আজ পর্যন্ত সেইদিন সকাল থেকে কোন সন্ধানই আর পাওয়া যায়নি, কথাটা জানেন বোধ হয়?
জানি। একটু যেন ভেবে সময় নিয়ে ধীরে কথাটা উচ্চারণ করল শকুন্তলা।
লোকটার চেহারা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে?
য়্যাঁ! একটু যেন চমকেই ওঠে শকুন্তলা, তারপর সেই ভাবটা সামলে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, তা মনে আছে বৈকি।
লোকটাকে আবার দেখলে বা তার কোন ফটো দেখলে চিনতে পারবেন আশা করি।
বোধ হয় পারব। কারণ তার চেহারা বেশ ঢ্যাঙা ছিল এবং বাঁ পা-টা ডিফেকটিভ থাকার দরুণ সামান্য একটু পা-টা টেনে কুঁজো হয়ে লোকটা চলত লক্ষ্য করেছিলাম।
আর একটি কথা শকুন্তলা দেবী, আপনি বোধ হয় এখন কিছুদিন এখানেই থাকবেন, তাই না?
তা ঠিক এখনো কিছু বলতে পারছি না। তারপর একটু থেমে বললে, ওরা যদি আমাকে রাখেন তো থাকতেও পারি।
সেরকম কোন কথা আজ পর্যন্ত-মানে বৃন্দাবনবাবুর সঙ্গে আপনার হয়নি?
না।
আচ্ছা, আর আপনাকে বিরক্ত করব না, উঠি-নমস্কার। কথাটা বলে ঘুরে তাকালো কিরীটী সুশান্তর দিকে এবং বললে, চলুন সুশান্তবাবু!
চলুন। সুশান্তও উঠে দাঁড়ায়।
১১. শকুন্তলার ঘর থেকে বের হয়ে
শকুন্তলার ঘর থেকে বের হয়ে উভয়ে আবার লাইব্রেরী ঘরেই ফিরে এসে প্রবেশ করল।
লাইব্রেরী ঘরের মধ্যে দুটো সোফায় মুখোমুখি বসে তখন বৃন্দাবন সরকার ও মধুসুদন। সরকার দুই ভাই নিম্নকণ্ঠে কি সব কথাবার্তা বলছিলেন। ওদের পদশব্দে দুজনাই মুখ তুলে তাকালেন।
বৃন্দাবনবাবু, আপনার কাকা সারদাবাবু যে ঘরে মারা গিয়েছিলেন সেই ঘরটা যে একটিবার দেখতে চাই! কিরীটী ঘরে ঢুকেই বৃন্দাবনবাবুকে লক্ষ্য করে কথাটা বললে।
বেশ তো চলুন—উঠে দাঁড়ালেন সঙ্গে সঙ্গে বৃন্দাবন সরকার।
সারদাবাবুর মৃত্যুর পর থেকে এযাবৎকাল তার নিজস্ব ঘরটা তালা দেওয়াই ছিল! বৃন্দাবন সরকার তার নিজের ঘর থেকে চাবিটা নিয়ে এসে ঘরের তালা খুলে ওদের নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন।
ঘরের জানলাগুলো বন্ধ ছিল।
কিরীটীর নির্দেশে বৃন্দাবন সরকার ঘরের জানলাগুলো খুলে দিলেন।
সুশান্তর মনে পড়ল, মাত্র এক পক্ষকাল পূর্বে এই ঘরে প্রথম যেদিন সে এসে পদার্পণ করেছিল, সামনেই ঐ মেঝেতে সারদাচরণ সরকারের নিপ্রাণ দেহটা পড়েছিল সেদিন।
সেই একই বাড়িতে গতরাত্রে আবার একজন নিহত হয়েছে। এবং সম্ভবত তারও মৃত্যুর কারণ একই।
বিষপ্রয়োগ!
একজন এই বাড়ির মালিক, অন্যজন তার বিশ্বস্ত পুরাতন ভৃত্য।
প্রভু সারদাচরণ সরকার ও তার ভৃত্য দশরথ।
ঘরের আসবাবপত্র সেদিন যেমনটি সে দেখেছিল আজও ঠিক তেমনটিই রয়েছে, মনে হল সুশান্তর।
সেই পালঙ্ক, সেই টেবিল, চেয়ার—
সহসা কিরীটীর ডাকে সুশান্ত তার দিকে ফিরে তাকালো।
সুশান্তবাবু?
বলুন।
সেদিন তো, মানে সারদাবাবুর মৃতদেহ যেদিন আবিষ্কৃত হয়, আপনি এ ঘরে এসেছিলেন? কিরীটীর প্রশ্নে মৃদুকণ্ঠে সুশান্ত জবাব দেয়, হ্যাঁ।
সেদিন ঘরের মধ্যে সব কিছু যেমন ছিল, আজও কি ঠিক তেমনিই অ্যাজ ইট ওয়াজ আছে বলে মনে হচ্ছে?
সুশান্ত বারেকের জন্য আবার ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে বললে, তাই তো মনে হচ্ছে।