মুহূর্তকাল বৃন্দাবন সরকার চুপ করে রইলেন। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, বেশ তাই হবে, তবে একটা রিকোয়েস্ট জানাব আপনাকে।
নিশ্চয়ই, বলুন!
কাকার মৃত্যুতে উনি বড় শক পেয়েছেন, সেই কারণেই আজ পর্যন্ত ওঁকে আমরা কেউই এখান থেকে যাবার কথা পর্যন্ত বলিনি…
ও!
হ্যাঁ, উনি নিজে থেকে যেদিন যাবেন যাবেন—তাই বলছিলাম এমন কোন কথা ওঁকে জিজ্ঞাসা করবেন না যাতে করে উনি মনে ব্যথা পান বা ওঁর কোনরূপ বিরক্তির কারণ ঘটে।
মুহূর্তকাল বৃন্দাবন সরকারের মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে মৃদকণ্ঠে কিরীটী বললে, তাই হবে। চলুন।
১০. লাইব্রেরী ঘর থেকে বের হয়ে
লাইব্রেরী ঘর থেকে বের হয়ে তারই লাগোয়া ঘরটির পর্দা-ফেলা-দরজার সামনে এসে সকলে দাঁড়াল।
চলুন। বৃন্দাবনবাবুই সর্বাগ্রে দরজার পর্দাটা হাত দিয়ে সরিয়ে ওঁদের আহ্বান জানালেন ভিতরে প্রবেশের।
প্রথমে বৃন্দাবনবাবু ও তার পশ্চাতে কিরীটী ও সর্বশেষে সুশান্ত ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে।
মাঝারি আকারের ঘরটি।
ঝকঝকে মোজেইক টাইলের ঠাণ্ডা মেঝে।
ঘরের একটিমাত্র জানলা খোলা ছিল, তবে জানলার পর্দা টেনে রাখার জন্য ঘরের মধ্যে দিনের বেলাতেও পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করতে পারেনি।
ঘরের একধারে একটি সিংগল খাটের উপরে বেডকভারে ঢাকা শয্যা।
অন্যদিকে একটি প্রমাণসাইজের আরশি-বসানো আলমারি। তার পাশে বড় একটি কালো ট্রাঙ্ক ও তার ওপরে একটি চামড়ার সুটকেস।
ঘরের অন্য কোণে ত্রিপয়ের উপরে সুদৃশ্য একটি টাইমপিস ও তার পাশে কারুকার্যখচিত একটি জয়পুরী ফ্লাওয়ার ভাসে একগুচ্ছ টাটকা বড় বড় ব্ল্যাকপ্রিন্স গোলাপফুল।
ফ্লাওয়ার ভাসটার সামনেই ধূপদানিতে প্রজ্বলিত একটি মোটা ধূপকাঠি।
গোলাপের ও চন্দন ধূপের সুমিষ্ট মিশ্র গন্ধ ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীকে আকৃষ্ট করেছিল।
আলমারিটার পাশেই আলনায় কয়েকখানি শাড়ি পাট করে রাখা।
ঘরের পশ্চিম কোণে একটি গোল টেবিলের চারপাশে খানতিনেক সোফা। তারই একটায় দরজার দিকে পিছন ফিরে বোধ হয় শকুন্তলা দেবী বসেছিলেন।
কারণ ঘরে ঢুকে তাকে না দেখা গেলেও তার মাথার কালো কেশ কিরীটীর চোখে পড়েছিল।
শকুন্তলা, মিঃ রায় এসেছেন!
বৃন্দাবনবাবুর গলার সাড়া পেয়ে শকুন্তলা উঠে দাঁড়াল সোফা থেকে।
ঈষৎ হরিদ্রাভ গাত্রবর্ণ।
লম্বায় পাঁচ ফুটের একটু বোধ হয় কমই হবে শকুন্তলা।
মুখখানা মঙ্গোলিয়ান টাইপের হলেও এবং ছোট চোখ ও নাকটা একটু চাপা হলেও মুখখানির মধ্যে চমৎকার আলগা একটি শ্ৰী আছে।
পরিধানে জরিপাড় ঈষৎ নীলাভ একটি তাঁতের দামী শাড়ি।
মাথায় পর্যাপ্ত কেশ। এলোমেলো হয়ে রয়েছে।
হাতে দুগাছি করে সোনার চুড়ি।
কানে নীলার টাব।
পায়ে চপ্পল।
না, না—আপনাকে উঠতে হবে না শকুন্তলা দেবী, আপনি বসুন বসুন-কিরীটী তাড়াতাড়ি বলে।
শকুন্তলা দ্বিরুক্তি না করে কিরীটীর অনুরোধে যে সোফাটার উপর বসেছিল, সেই সোফাতেই পুনরায় বসে পড়ল।
তাহলে আপনি কথা বলুন ওঁর সঙ্গে মিঃ রায়। আমি লাইব্রেরী ঘরে আছি। বৃন্দাবন সরকার ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী আর সুশান্ত দুজনে অন্য দুটি খালি সোফায় পাশাপাশি বসল।
আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত শকুন্তলা দেবী, তবে বেশীক্ষণ আপনাকে বিরক্ত আমি করব না। দুচারটে কথা আপনাকে আমার জিজ্ঞাস্য আছে মাত্র।
শকুন্তলা কিরীটীর কথায় বারেকের জন্য মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল নিঃশব্দে, পুনরায় নিঃশব্দেই মুখটা নামিয়ে নিল।
আমার পরিচয়টা সর্বাগ্রে আপনাকে বোধ হয় দেওয়া কর্তব্য মিস ত্রিবেদী। কিরীটী বললে।
বৃন্দাবনবাবুর মুখেই শুনলাম, আপনি মিঃ সরকারের হত্যারহস্যের তদন্তের জন্যই এসেছেন!
ও, তাহলে বোধ হয় আমার বক্তব্য আমি শুরু করতে পারি?
বলুন, কি জানতে চান?
সহজ সতেজ কণ্ঠস্বর শকুন্তলার।
সারদাবাবুকে নিয়মিত বই পড়ে শোনানো ও তার লেখাপড়ার টুকটাক কাজগুলো করে দেবার জন্যই তো আপনি নিযুক্ত হয়েছিলেন, তাই না? কিরীটী এবার প্রশ্ন শুরু করে।
হ্যাঁ।
আচ্ছা, সারদাবাবুর মেজাজ কি রকম ছিল শকুন্তলা দেবী?
খুব ঠাণ্ডা ও ধীর মেজাজ ছিল তার, কচিৎ কখনো হয়তো রেগে উঠতেন—
নিজের মতের সঙ্গে না মিললেই, এই তো?
হ্যাঁ।
আপনি তো এখানে প্রায় মাস আষ্টেক আছেন, তাই না?
হ্যাঁ।
এই সময়ের মধ্যে বৃন্দাবনবাবু এখানে কি রকম আসা-যাওয়া করতেন?
হপ্তায় দুবার বা মাঝে মাঝে তিনবারও এসেছেন।
এই কমাসে আপনার তার সঙ্গে নিশ্চয়ই বেশ আলাপ হয়েছে! কথাটা বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটী শকুন্তলার মুখের দিকে তাকায়।
কেন বলুন তো মিঃ রায়? আপনার জিজ্ঞাস্যটা ঠিক কি জানতে পারি কি? পালটা প্রশ্ন করে শকুন্তলা ড়ু উত্তোলিত করে তাকালো কিরীটীর মুখের দিকে সুস্পষ্ট দৃষ্টিতে প্রায় যেন সঙ্গে সঙ্গেই।
না, না-আপনি অন্য রকম কিছু ভাববেন না শকুন্তলা দেবী, বৃন্দাবনবাবু সম্পর্কে আপনার ধারণাটাই জিজ্ঞাস্য শুধু।
ওঃ! তা ভদ্রলোক পারফেক্ট জেটেলম্যান বলেই তো আমার মনে হয়।
আর মধুসূদনবাবু?
কিরীটীর শেষের কথায় চমকে যেন শকুন্তলা দেবী তাকালো তার মুখের দিকে মুহূর্তের জন্য। এবং ক্ষণেকের সেই চমকটা কিরীটীর দৃষ্টিকে তো এড়ায়নিই, সুশান্তর দৃষ্টিকেও ফাকি দিতে পারে না।
কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যই। পরক্ষণেই শান্ত স্থির দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, I am sorry! ভদ্রলোকের সঙ্গে বিশেষ কোন আলাপের এখনও কোন সুযোগই আমার হয়নি। কাজেই তার সম্পর্কে কোন কথা আমি বলতে পারবও না।