সুব্রতর কথায় কিরীটী মৃদু হেসে বলে, তার জন্যও চিন্তা নেই সুব্রত বাবু। কালো ভ্রমরকে আমাদের গৃহেই আসতে হবে।
এ আপনি কি বলছেন?
ঠিকই বলছি, এমন একটি বহুমূল্য সম্পদ হতে সে বঞ্চিত হয়েছে এবং বর্তমানে যা সম্পূর্ণ আমার অধিকারে, তারই আকর্ষণে সে আসবে। হ্যাঁ, কালো ভ্রমর আসবে। আসতে তাকে হবেই।
কিরীটীর কথাগুলো সুব্রতর নিকট যেন কেমন রহস্যপূর্ণ বলে মনে হয়। যেন পূর্ণ হেয়ালি।
আমি আপনার কথা কিছু বুঝতে পারলাম না কিরীটীবাবু।
ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই সুব্রতবাবু। সময় এলেই সব বুঝতে পারবেন।
এমন সময় সিঁড়িতে জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। কিরীটী যেন হঠাৎ উদগ্রীব হয়ে ওঠে, ঐ রাজেনবাবু আসছেন, আর তাঁর সঙ্গে বোধ হয় সলিলবাবুও আসছেন—যদি আমার অনুমান মিথ্যা না হয়ে থাকে।
সত্যিই কিরীটীর কথা শেষ না হতে হতেই প্রথমে রাজু এবং তার পশ্চাতে সলিলবাবু এসে ব্যালকনিতে প্রবেশ করলেন।
আসুন মিঃ সেন। কিরীটী আহ্বান জানায়, আপনাকে ডাকতে রাজেনবাবুকে পাঠিয়েছিলাম বটে, তবে ভাবিনি এখনই আপনি আসবেন।
জানেন তো বিদেশে স্বজাতি– সলিলবাবু হাসতে হাসতে চেয়ারে উপবেশন করলেন। তারপর প্রাথমিক পরিচয়-পর্ব শেষ করে সলিলবাবু বললেন, রাজেনবাবুর মুখেই সব শুনলাম মিঃ রায়।
এখন আপনি আমাদের সম্পূর্ণ ভরসা মিঃ সেন, কিরীটী বলে, আচ্ছা অমরবাবুর মত্যু সম্পর্কে আপনার মতামত কি জানতে পারি কি?
নৃশংস হত্যা সন্দেহ নেই। বরং এ যে সেই আগের ঘটনারই জের, তাও আমাদের ধারণা।
তারপর আবার একসময় কিরীটী কথায় কথায় সলিল সেনকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা মিঃ সেন, অমরবাবু যে কক্ষে শয়ন করতেন, সেখান থেকে চিৎকার করলে বা কোন গোলমাল হলে, নীচের ভৃত্যদের ঘরে কি শোনা যায়?
না। আমি সেটা পরীক্ষা করে দেখেছি, শোনা যায় না।
ভৃত্য তাহলে কোন চিৎকার বা গোলমালই শুনতে পায়নি সে-রাত্রে?
না।
আচ্ছা লোকটা এদেশীয় কি?
হ্যাঁ।
লোকটা এখন কোথায়, নিশ্চয়ই হাজতে? ভাল কথা, করোনারের ভারডিকট কি?
কেউ বা কারও দ্বারা অমরবাবু নিঠুর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন।
আচ্ছা আপনাদের ডি, আই, জি, লোকটা ইউরোপীয়ান নিশ্চয়ই?
অ্যাংলো-বার্মিজ।
আপনাদের ডিপার্টমেন্টে কালো ভ্রমরের একটা full details নিশ্চয়ই আছে?
আছে। সে
টা আমি একবার দেখতে পারি কি?
নিশ্চয়ই, কাল আমার ডিপার্টমেন্টে আসবেন, দেখাব। তাছাড়া আমাদের সুপারও আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হতে ইচ্ছুক।
রাত্রি প্রায় নটার সময় ইন্সপেক্টার সলিল সেন ওদের নিকট হতে বিদায় নিলেন।
ভৃত্য ঐ সময় সংবাদ দিল আহার্য প্রস্তুত। আহারাদির পর সকলে এসে যে যার শয্যায় আশ্রয় নিল।
সুব্রত ভাবছিল কিরীটীর কথাগুলিই। কিরীটীর অদ্ভুত বিচার ও বিশ্লেষণ শক্তি সত্যই তাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু তবু কিছুতেই সে যেন বুঝে উঠতে পারছিল না, কেন কিরীটীর ধারণা কালো ভ্রমর সনৎদাকে এখনই প্রাণে মারবে না!
কি জানি, সুব্রত আবার ঐ সঙ্গে ভাবে, সব কথা যে কিরীটীবাবু, খোলসা করে খুলে বলতে চান না!
উনি কি সুব্রতকে বিশ্বাস করেন না?
রাজুকে যে সলিলবাবুর সন্ধানে পাঠিয়েছেন, সে কথা পর্যন্ত উনি তার নিকট গোপন করে রেখেছিলেন, কিন্তু কেন?
আর কিরীটী ভাবছিল সম্পূর্ণ অন্য কথা। কালো ভ্রমর নিজে থেকে ধরা না দিলে কোনমতেই তাকে ধরা যাবে না।
সনৎ-এর উধাও হওয়ার দিন থেকে পর পর এই কদিনের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে যেন তাই মনে হচ্ছে।
অবিবেচকের মত কোন কাজই কালো ভ্রমর করতে পারে না। প্রতিটি পদবিক্ষেপ সে হিসাব করে ফেলে।
এত বড় দলের যে দলপতি, অথচ কেউ আজ পর্যন্ত তার আসল পরিচয়টা পর্যন্ত জানে না এবং জানাতেও কালো ভ্রমর শুধু ইচ্ছুকই নয় তাই নয়, যাতে অন্য কেউ তার সত্যকারের পরিচয়টা না জানতে পারে, তার জন্য সে অত্যন্ত সচেষ্ট ও যত্নবান। কিন্তু কেন?
১৮. রাতের আঁধারে অনুসরণ
রাতের আঁধারে অনুসরণ
রাত্রি কত হবে কে জানে? সুব্রত আর কিরীটী পাশাপাশি এক শয্যায় শুয়ে। সুব্রত বোধ হয় অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। তার গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ বেশ স্পষ্ট শোনা যায়।
ও-পাশের একটা খাটে ঘুমিয়ে আছে রাজু। সেও গভীর নিদ্রায় অচ্ছিন্ন।
গত দু রাত্রি কিরীটীর ভাল করে ঘুম হয়নি। কাজেই দু চোখের পাতা এবারে ঘুমে ভারী হয়ে আস্তে আস্তে বুজে আসে।
কিন্তু সহসা মাঝরাত্রে অত্যন্ত গরম বোধ হওয়ায় কিরীটীর ঘুম ভেঙে গেল।
রাত্রি কত হয়েছে ঠিক নেই। কিসের যেন একটা অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মনে হল যেন পাশের অন্ধকার ঘর থেকে শব্দটা আসছে!
কিরীটী উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। পাশেই সুব্রত গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, তার নিদ্রার কোন ব্যাঘাত হয়েছে বলে তো মনে হয় না।
হ্যাঁ, কার যেন সাবধানী পায়ের নিঃশব্দে চলাচলের অপষ্ট মদ, আওয়াজ। এত রাত্রে পাশের ঘরে কে?
খানিক পরে সে শব্দটা আর শোনা গেল না।
কিন্তু আবার! হ্যাঁ, ঐ তো আওয়াজটা আবার পাওয়া যাচ্ছে। কেউ নিশ্চয়ই নিঃশব্দে ঘরে হেটে বেড়াচ্ছে! না, দেখতে হল!
কিরীটী উঠে বসে। শয্যা ত্যাগ করে দু ঘরের মধ্যবর্তী যে দরজাটা আছে তার সামনে গিয়ে সে কান পেতে দাঁড়াল। তারপর দরজাটার গায়ে হাত দিয়ে ঠেলতে গিয়ে দেখল দরজাটা ওদিক হতে বন্ধ। আশ্চর্য, শোয়ার সময়ও তো দরজাটা খোলাই ছিল! তবে? কিরীটী আরও একটু জোরে দরজাটা ঠেলা দিল। কিন্তু দরজা খুলল না। কিরীটী বিস্মিত, বিমূঢ়।