কিন্তু–
এর মধ্যে আর কোন কিন্তুই নেই সুব্রতবাবু। পাশার দান উল্টে গেছে, এ কথা খুবই সত্যি। কিন্তু আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর পাশার ঘুটি আবার নতুন করে সাজাবার মত বুদ্ধি বা ক্ষমতা বেশ আছে। এবং এবারে তার প্রথম ও প্রধান চেষ্টাই হবে, যাতে গতবারের মত ভুলের জের আর তাকে না টানতে হয়। সে যে একজন দস্তুরমত শয়তান সে বিষয়ে কোন মতদ্বৈধই নেই। সেই সঙ্গে এ কথাটাও যেন আমরা মুহূর্তের জন্য না ভুলি যে, বুদ্ধি তার অসম্ভব রকম তীক্ষ্ণ। কাজেই বুদ্ধির কৌশলে তাকে পরাস্ত করতে হলে ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের একান্তই প্রয়োজন। বলতে বলতে হঠাৎ চমকে উঠে উৎকণ্ঠামিশ্রিত কণ্ঠে কিরীটী বলে উঠল, সরে যান সরে যান!
কিন্তু সরে যাওয়ার আগেই সাইকেল-সমেত একজন আরোহী এসে হড়মড় করে একেবারে সুব্রতর ঘাড়ের ওপর পড়ল। এবং সঙ্গে সঙ্গে সুব্রত উঃ করে একটা অস্ফুট চিৎকার করে একদিকে ছিটকে পড়ল।
সকলে মিলে ভূপতিত সুব্রতকে সামলাবার আগেই সাইকেল-আরোহী সাইকেল ফেলে একছুটে সামনের একটা সরু গলিপথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিরীটী এগিয়ে এসে সুব্রতকে তুলতে তুলতে স্নেহ ও উদ্বেগপূর্ণ স্বরে প্রশ্ন করল, লেগেছে কি? কোথায় লাগল?
সুব্রত ডান হাত দিয়ে বাম দিককার কোমরটা চেপে ধরে উঠতে উঠতে কাতর-স্বরে বললে, কোমরে একটু লেগেছে।
ততক্ষণে রাস্তায় কৌতুহলী পথিকদের মধ্যে অনেকেই সেখানে এসে জুটেছে। নানারকম প্রশ্ন ও মন্তব্যে স্থানটি বেশ মুখর হয়ে উঠেছে। ভিড় ও অবান্তর প্রশ্নোত্তর এড়াবার জন্য কিরীটী হাতের ইশারায় একখানা চলন্ত ট্যাক্সি ডাকল এবং সকলে ট্যাক্সিতে উঠে বসে বললে, আমহার্স্ট স্ট্রীট।
ট্যাক্সি ছুটে চলল।
কৌতূহলী হুজুগপ্রিয় পথিকেরা এমন একটা সরল ব্যাপার সহসা বিনা গোলমালে থেমে যেতে বেশ একটু মনঃক্ষুণ্ন হল এবং অগত্যা যে যার গন্তব্যপথে চলে গেল।
চলমান ট্যাক্সিতে বসে গভীরভাবে বললে কিরীটী, চারিদিকে চেয়ে পথ চলতে হয় সুব্রতবাবু!
সুব্রত সে কথায় কান দিল না। সে ততক্ষণে বাঁ হাত দিয়ে একটা মোটা পিনসমেত একখানি গোল কার্ড কাপড় থেকে টেনে বের করে হাতের পাতার উপর মেলে দেখছিল। এ সেই রকমের একখানি কার্ড, যেমনটি রাজু-র গায়ে পরশু রাতে বিধেছিল। তাতে খুব ছোট ছোট অক্ষরে কি যেন লেখা। কার্ডখানা চোখের কাছে নিয়ে সুব্রত পড়লে–
বন্ধু, কালো ভ্রমরের হুল শুধু হুলই নয়, এতে বিষের জ্বালাও আছে। সেই বিষ একবার শরীরে ঢুকলে আর নামে না। সাবধান!
১২. আবার যাত্রা শুরু
পিনটা কালো রংয়ের– দেখতে একটা মোটা বেলের কাঁটার মতই। তার এক দিক সূচের আগার মত তীক্ষ্ণ ও ধারালো, অন্য দিকটা ভোঁতা। পিনটা যেখানে বিধেছিল, সেখানে হাত বুলোতে বুলোতে সুব্রত কাতর স্বরে বললো, উঃ, এখনও জ্বালা করছে!
ট্যাক্সিটা তখনও হ্যারিসন রোড ধরে পুবদিকে ছুটে চলেছে। ট্যাক্সিচালক মুখ ফিরিয়ে শুধাল, আমহাস্ট স্ট্রীট মে কিধার বাবুসাব?
তুমি চল। আমি বলব খন। কিরীটী ড্রাইভারের দিকে চেয়ে বলল।
হ্যারিসন রোড ও আমহাস্ট স্ট্রীটের সংযোগস্থলে এসে কিরীটী ড্রাইভারকে বললে, গাড়ির মোড় ফিরিয়ে আমহার্স্ট স্ট্রীট ধরে এগিয়ে যেতে।
সুব্রতদের আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়িতে পৌঁছে কিরীটী সেখানে খানিকক্ষণ বিশ্রাম করল। তারপর বিকেলের দিকে আবার আসবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাস্তায় গিয়ে নামল।
বেলা প্রায় তখন দেড়টা হবে। আবার যাত্রার উদ্যোগে সুব্রত একটা একটা করে আবশ্যকীয় জিনিসপত্র রাজুর দিকে এগিয়ে দিচ্ছে, আর রাজু সেগুলো একটা চামড়ার সুটকেসের মধ্যে সাজিয়ে-গুছিয়ে ভরে রাখছে।
একটা বড় তোয়ালে ভাঁজ করে সুটকেসের মধ্যে রাখতে রাখতে একসময় রাজু বললে, কিন্তু তোমরা যতই বল ভাই, মনের মধ্যে থেকে কিছুতেই যেন আমি সাড়া পাচ্ছি না সুব্রত। সনৎদা এখানে পড়ে রইল, আমরা চলেছি রেঙ্গুনের দিকে। এমনি ভাবে বৃথা অতদূর ছুটে গিয়ে যে কি লাভ হবে, তা মিঃ রায়ই জানেন।
সুব্রতও মন থেকে সায় পাচ্ছিল না। সে বললে, মিঃ রায়ের মত তো শুনলে।
শুনলাম তো, যা ভাল বোঝ কর। তিনি নিশ্চয়ই ভাল বুঝেই রেঙ্গনে চলেছেন।
এমন সময় মা এসে ঘরে ঢুকলেন, বললেন, হ্যাঁ রে, তা হলে সত্যিই কাল ভোরের জাহাজেই আবার তোরা সেই মগের মুল্লকে চললি?
এখন পর্যন্ত তো তাই ঠিক মা, তবে জাহাজে চাপবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বলা যায় না।
কিন্তু সনৎ-এর তো কোন খোঁজখবর মিলল না!
খোঁজ পাওয়া গেছে মা। সনৎদা প্রাণে বেচে আছে, এই পর্যত জেনে রাখ।
আহা, বেচে আছে তো? ঠিক খবর পেয়েছিস তো?
হ্যাঁ, মা। মিঃ রায় খবর এনেছেন।
আহা, ভগবান তার ভাল করন। বলতে বলতে মার চোখের কোণ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠল। তিনি আবার বললেন, কোথায় তিনি তার দেখা পেলেন?
তা তো জানি নে মা, জিজ্ঞাসা করিনি সে কথা।
তা বাছাকে আমার নিয়ে এল না কেন?
সুব্রত মার কথায় মৃদু হেসে বলল, তারা ছেড়ে দেবে বলে তো আর কত কষ্ট করে চুরি করে নিয়ে যায়নি মা?
তা সে এইখানে পড়ে রইল, আর তোরা চললি রেঙ্গুনে?
ভয় নেই মা, এখানে থেকে তাকে উদ্ধার করা যাবে না, তাই আমরা রেঙ্গুন যাচ্ছি কাল।
হঠাৎ সকলে ঘরের মধ্যে অন্য একজনের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ফিরে তাকায়। দেখলে দরজার কপাটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে কিরীটী রায়।