পুলিস তো সব কিছুই একটু সন্দেহের চোখে দেখবে—প্রশ্ন করবে শিবতোষবাবু!
তা করে করুক না, তাই বলে আমার ব্যক্তিগত জীবনে অতীতে কার কি ঘটেছে সে ব্যাপারে এত অনাবশ্যক কৌতূহল কেন? আর আমার নিজের অতীতের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে খোকার খুনের সম্পর্কই বা কি! আর ঐ শিখেন্দুই বা যে কেন বলতে গেল আমি আমার বাড়ির অমতে এবং বাবাকে না জানিয়ে প্রথমবার বিয়ে করেছিলাম, সে স্ত্রী নেই—
হয়ত কিছু ভেবেই দারোগাবাবু প্রশ্নটা করেছেন। তারই উত্তর দিয়েছেন শিখেন্দুবাবু। কিরীটী শান্ত গলায় জবাব দিল।
তবু বলব—অহেতুক, অনাবশ্যক কৌতূহল। আমি আমার সম্পত্তির কি ব্যবস্থা করব, সে-বিষয়ে কিছু কখনও ভেবেছি কিনা
সেটাও হয়ত আপনার আর একটি সন্তান আছে জেনেই করেছিলেন তিনি।
সে আমাকে তার বাপ বলেই জীবনে কখনও স্বীকার করেনি, কোন সম্পর্কই আমার সঙ্গে রাখেনি–কাজেই সে থাকা না-থাকা দুই সমান–
তাহলেও আইনের দিক দিয়ে আপনার দুই ছেলে যখন, তখন আপনার সমস্ত সম্পত্তির সমান অংশীদার দুজনে।
আপনি জানেন না কিরীটীবাবু, দিলেও যে একটি সম্পদও সে আমার কখনও স্পর্শ করবে না, আমি খুব ভাল করেই জানি সে আমাকে ঘৃণা করে। তার মামারা, তার মামাদের মধ্যে যেমন সে বড় হয়েছে, একটু একটু করে একটা ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছে যে, তার মায়ের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। অবহেলা করে তার মাকে আমি মৃত্যুর মধ্যে ঠেলে দিয়েছি। হ্যাঁ, এটা ঠিক, বাবা তাকে কখনও স্বীকার করে নেবেন না বলে, এ-বাড়ির বধূর যোগ্য মর্যাদা দিয়ে, এখানে তার নিজস্ব গৌরবে, তাকে বিয়ে করা সত্ত্বেও, এনে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি কিন্তু তার মৃত্যু
কিরীটী বাধা দেয় না কোনরূপ মন্তব্যও প্রকাশ করে না। কারণ সে বুঝতে পেরেছিল, সম্পূর্ণ ঝোঁকের মাথাতেই জীবনের এক গভীরতম শোকের মুহূর্তে বিহুল বিমূঢ় শিবতোষ মল্লিক তাঁর অতীত জীবনের দুঃখের কথা বলে চলেছেন। যে ব্যথাটা হয়ত নিরুপায়, এত বছর ধরে তাঁর বুকের নিভৃতে গুমরোচ্ছে-আজ জীবনের এক চরম শোকের বিহ্বলতায় সেটা আপনা থেকেই বের হয়ে আসছে।
এ তো কান্নারই নামান্তর ছাড়া কিছুই নয়।
অসাধারণ মনের বল ও সংযম ভদ্রলোকের, তাই এখনও হাউ হাউ করে না চেঁচিয়ে স্থির হয়ে আছেন, যদিও প্রথম মুহূর্তে ঘটনার আকস্মিক আঘাতে সহসা জ্ঞান হারিয়েছিলেন।
শিবতোষ যেমন বলছিলেন তেমনি বলতে লাগলেন, সান্ত্বনার মৃত্যুটামানে একটু একটু করে তাকে নিঃশেষ হয়ে যেতে, সেদিন আমাকে একপ্রকার যেন নিরুপায় হয়ে বসে বসেই দেখতে হয়েছিল।
কি হয়েছিল তাঁর?
সারকোমা–বাঁ হাতের হাড়ে সারকোমা। জানি সে রোগের কোন চিকিৎসাই ছিল না, তবু টাকা হাতে থাকলে তাকে আমি বিদেশে নিয়ে গিয়ে শেষ চিকিৎসাটুকু অন্ততঃ করাতে পারতাম, কিন্তু বাবা তখন বেঁচে, সব তাঁর হাতের মুঠোর মধ্যে। সামান্য মাসোহারা ছাড়া তখন আর কিছুই আমি পাই না। কিন্তু সে আর কত, চার-পাঁচশো টাকা মাত্র!
তারপরই বোধ হয় অতীত স্মৃতির বেদনায় কয়েকটা মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে থেকে আবার উদাস কণ্ঠে বলতে লাগলেন শিবতোষ, তবুমাকে দিয়ে আমি বাবাকে বলিয়ে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু লোহার মত কঠিন মন তাঁর কিছুতেই গলল না।
আপনার স্ত্রীও তো নিজে আসতে পারতেন এ-বাড়িতে, তাঁর অধিকারকে জোর করে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য!
যেমন ভীরু তেমনি কোমল প্রকৃতির ছিল সান্ত্বনা, তা সত্ত্বেও সে দু-দুবার এসে বাবার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করেছে আমাকে না জানিয়েই, প্রথমবার তার ভাইদের সঙ্গে, কিন্তু বাবা দূর-দূর করে সান্ত্বনাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, শেষবারও অসুস্থ অবস্থাতেই মরার মাস দুই আগে এসেছিল এবং সেবারে আমিও সঙ্গে ছিলাম, ঢুকতে দিলেন না বাড়িতে। সান্ত্বনার ছেলের বয়স, মানে আমার সেই বড় ছেলে, তার বয়স তখন আড়াই বৎসর। তার মামাদেরও আমি দোষ দিই না কিরীটীবাবু। সান্ত্বনার বড় ভাই শশী, আমারই ক্লাসফ্রেণ্ড ছিল, সেও আমাকে বুঝল না।
একটু থেমে শিবতোষ আবার বলতে লাগলেন, সান্ত্বনার মৃত্যুর প্র আমি আমার কর্তব্য করতে পারিনি কয়েক বছর। বাবাকে অনেক বলেছিলাম, কিন্তু কিছুতেই আমার প্রথম সন্তানকে গ্রহণ করতে সম্মত হলেন না। শেষটায় একবার বলেছিলেন, বেশ কিছু অর্থ সাহায্য তাকে করতে পারি, কিন্তু এ বাড়িতে তার স্থান হবে না।
আশ্চর্য কঠিন মন তো ছিল রায়বাহাদুরের!
সে যে কি কঠিন আমিই জানি। তারপর নিজের ইচ্ছেমত যখন খরচ করবার সুযোগ এল আমার জীবনে, ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, কিন্তু সে দেখাও করল না। ভাবতে পারেন কিরীটীবাবু, লক্ষপতি শিবতোষ মল্লিকের ছেলে লেখাপড়া করল না, কিছু না, সাধারণ একটা জুট মিলের শ্রমিক, অর্ডিনারী লেবারার—শিবতোষের গলার স্বর যেন বুজে এল।
চোখে জল নেই, কিন্তু কিরীটীর মনে হচ্ছিল, কান্নায় যেন ভদ্রলোকের বুকের ভেতরটা তোলপাড় করছে।
বাবা!
শিবতোষের বড় মেয়ে স্মৃতি এসে ঘরে ঢুকল।
ডাক্তার চৌধুরীকে একবার ফোন করলে হতো না—
কেন?
বৌদি যে জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে বোবা হয়ে বসে আছে, এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলল না। এক ফোঁটা চোখের জলও নেই, আমার যেন কেমন ভাল লাগছে না। বাবা।
বেশ ফোন করে দাও।
কি বলব ফোনে?
আমি ডেকেছি তাই বলল। তোমার মা?
মার তো ঘন ঘন ফিট হচ্ছে।