স্বাতীদেবীকে আগে ডাকুন, তারপর তাঁর দিদি স্মৃতিদেবীকে ডাকবেন।
আপনি বসুন, আমি ডেকে নিয়ে আসছি স্বাতীকে। শিখেন্দু ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবং একটু পরেই স্বাতীকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। বসুন স্বাতীদেবী, বীরেন মুখার্জী বললেন।
আমি দাঁড়িয়েই আছি, আপনি কি জানতে চান? স্বাতীর কণ্ঠস্বর অসহিষ্ণু ও বিরক্ত মনে হল।
আজ রাত্রে বৌকে কোথায় বসানো হয়েছিল?
দোতলার একটা ঘরে। স্বাতী বললে।
সেখান থেকে কখন বৌকে ওপরে নিয়ে যাওয়া হয়?
বোধ হয় রাত পৌনে বারোটা কি বারোটা হবে তখন।
কে নিয়ে গিয়েছিল বৌকে ওপরে?
আমিই দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে চলে আসি নীচে নেমে।
সে-সময় বারান্দার তিনতলায় কাউকে দেখেছিলেন?
স্বাতী জবাব দেবার আগেই কিরীটী এসে পারলারে ঢুকল। সকলেই কিরীটীর দিকে তাকাল এক সঙ্গে।
কিরীটী ঘরের মধ্যে উপস্থিত তিনজনের মুখের দিকেই পর্যায়ক্রমে একবার তাকিয়ে নিল। তারপর শিখেন্দুর দিকেই তাকিয়ে বললে, শিবতোষবাবুকে একটা খবর দিতে পারেন?
চলুন ওপরে, কাকাবাবু ওপরে তাঁর ঘরের মধ্যেই আছেন। শিখেন্দু বললে কিরীটীর কথাটা শেষ করার আগেই। বীরেন মুখার্জীর পরনে ইউনিফর্ম ছিল, তাই তাঁর সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও কিরীটী অনুমানেই বুঝতে পারে তিনি একজন পুলিসেরই অফিসার। এবং সেই অনুমানের ওপরেই নির্ভর করে বীরেনের দিকে তাকিয়ে বললে, মনে হচ্ছে আপনি এ এলাকার থানা অফিসার!
জবাব দিল শিখেন্দুই, হ্যাঁ মিঃ রায়, উনিই এখানকার থানা-অফিসার বীরেন মুখার্জী।
নমস্কার, আমি কিরীটী রায়। কিরীটী বললে।
নমস্কার। বীরেন বললেন, আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হবার সৌভাগ্য আমার হয়নি বটে, তাহলেও আপনার নাম আমি অনেকই শুনেছি আমাদের ডি.সি, চাটুয্যে সাহেব তো আপনার প্রশংসায় একেবারে উচ্ছ্বসিত–
শিবতোষবাবু আমার বিশেষ পরিচিত, তাঁর ছেলে ডাঃ নির্বাণীতোষ মল্লিককেও আমি চিনতাম—আজ এখানে আমি নিমন্ত্রণে এসেছিলামও।
আমিও এসেছিলাম কিরীটীবাবু।
আপনিও এসেছিলেন?
হ্যাঁ–বসুন না।
কিরীটী বীরেন মুখার্জীর আহ্বানে তাঁর সামনেই একটা সোফায় উপবেশন করল। তারপর প্রশ্ন করল, মৃতদেহ দেখেছেন?
হ্যাঁ-মোটামুটি যা দেখবার দেখেছি, ভাবছিলাম এবারে এ-বাড়ির লোকদের জবানবন্দি নেব। বীরেন মুখার্জী অতঃপর যা দেখেছিলেন ও শুনেছিলেন, সংক্ষেপে বলে গেলেন।
সব শুনে কিরীটী কেবল একটা কথাই বললে, শিবতোষবাবুর দুই বিয়ে? আগের স্ত্রীর একটি সন্তানও আছে?
তাই তো শুনছি। প্রথমা স্ত্রী সান্ত্বনাদেবীর মৃত্যুর বছরখানেক বাদে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন।
প্রথমা স্ত্রী কি এ বাড়িতে কখনও আসেননি? কিরীটী প্রশ্ন করল।
জবাব দিল শিখেন্দু, না, আসেননি।
চার বছর তো বেঁচেছিলেন—
তা ছিলেন, তবে রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিক কাকাবাবুর প্রথমা স্ত্রীকে কোনদিনই স্বীকার করেননি।
স্বাভাবিক। তাঁকে যতটুকু আমি দেখেছিলাম, আভিজাত্য ও অর্থের অহঙ্কার একটু বেশী মাত্রাতেই ছিল। কাজেই তাঁর পক্ষে তাঁর পুত্রের—তাঁর, জ্ঞাতে ও অজ্ঞাতে বিশেষ করে, এক সাধারণ গরীবের ঘরের মেয়েকে পুত্রবধূ বলে স্বীকার করে নেওয়া একটু কষ্টকর বৈকি।
আপনি তাঁকে দেখেছিলেন কিরীটীবাবু? বীরেন মুখার্জী প্রশ্ন করলেন।
দেখেছি, মাত্র বছর কয়েক আগেই তো তিনি মারা গেছেন। কিরীটী বললে।
আমার মনে হয়, শিবতোষবাবুর অতীত জীবনের ব্যাপারে কোথায়ও একটা জট পাকিয়ে ছিল–নচেৎ তাঁর ছেলে জীবনে কখনও এ-বাড়িতে পদার্পণ করল না কেন? বীরেন মুখার্জী বললেন।
থাকাটা কিছু অসম্ভব নয় বীরেনবাবু! যাক, আপনি তাহলে আপনার কাজ করুন। আমি এবার শিবতোষবাবুর সঙ্গে দেখা করে তিনতলায় মৃতদেহটা দেখে আসি।
ঠিক আছে, আপনি যান। আপনি না আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব।
না না—আমার জন্য আপনাকে বসে থাকতে হবে না। আমি না হয় কাল দিনের বেলায় কোন এক সময়ে আপনার সঙ্গে গিয়ে দেখা করব। শিবতোষবাবু আমার বিশেষ পরিচিত, তাছাড়া আপনার সাহায্য ছাড়া আমার পক্ষে কিছু করাই সম্ভবপর নয়। বীরেন মুখার্জীর মুখের ভাব দেখে মনে হল কিরীটীর শেষের কথায় তিনি যেন একটু খুশিই হয়েছেন। আমি তাহলে ওপর থেকে ঘুরে আসি!
আসুন।
চলুন শিখেন্দুবাবু, কিরীটী বললে।
চলুন।
বাড়িটা তেমনি স্তব্ধ। সর্বত্র তেমনি তখনও আলো জ্বলছে।
নির্বাণীতোষের মা কল্যাণীদেবীর কান্নার শব্দটা তখন আর শোনা যাচ্ছে না। বারান্দা অতিক্রম করে কিরীটী শিখেন্দুর পেছনে পেছনে এসে শিবতোষবাবুর শয়নকক্ষে প্রবেশ করল। শিবতোষ তখনো তেমনি করেই তাঁর ঘরের মধ্যে আরামকেদারাটারওপর বসে আছেন মুহ্যমানের মত।
সমস্ত মুখে একটা অসহায় বেদনার ক্লান্তি। পদশব্দে মুখ তুলে তাকালেন শিবতোষ, আসুন কিরীটীবাবু
আপনি উঠবেন না। বসুন মল্লিক মশাই।
শিবতোষ উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন কিন্তু কিরীটীর কথায় আর উঠলেন না, বসেই রইলেন।
আমি জানি কিরীটীবাবু, আপনি বের করতে পারবেন—কে অমন নিষ্ঠুরভাবে খোকাকে খুন করে গিয়েছে। শিখেন্দু—শিবতোষের গলাটা যেন কান্নায় বুজে এল।
আজ্ঞে? শিখেন্দু তাকাল শিবতোষের মুখের দিকে।
দারোগাবাবু চলে গেছেন?
না । নীচে এখন সকলের জবানবন্দি নেবেন। স্বাতীর জবানবন্দি নিচ্ছেন।
তুমি তাহলে নীচেই যাও।
শিখেন্দু নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। শিখেন্দু ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই শিবতোষ বললেন, ভদ্রলোক একটু বেশী মাত্রায়ই যেন ইকুইজিটিভ। যেটা আমার একেবারেই ভাল লাগেনি কিরীটীবাবু!