দীপিকাদেবী!
বাধা দিল এবারে স্বাতীই, নির্বাণীতোষের বোন। বললে অসহিষ্ণু কষ্ঠে, কেন ওকে বিরক্ত করছেন দারোগাবাবু এভাবে! ওকে এখন প্রশ্ন করে লাভ নেই। কোন প্রশ্নেরই জবাব পাবেন না ওর কাছ থেকে।
আপনার কথাঠিকইস্বাতীদেবী, কিন্তু বুঝতেই পারছেন, আইনের দিক থেকে আমি নিরুপায়।
না, প্লিজ, ওকে এখন বিরক্ত করবেন না। আমাদের যা-সর্বনাশ হবার তো ইয়েই গিয়েছে, ওকে এখন উত্ত্যক্ত করবেন না।
ঠিক আছে, কাল সকালে আমি কোন এক সময় না হয় আসব, চলুন শিখেন্দুবাবু, বীরেন মুখার্জী বললেন।
শিবতোষের ঘরে এসে যখন ওরা ঢুকল, শিবতোষ তখন কাকে যেন ফোন করছেন।
নির্বাণীতোষের আকস্মিক মৃত্যুটা শিবতোষকে প্রথমটায় সত্যিই বিমূঢ় করে দিয়েছিল। প্রত্যেককেই একদিন না একদিন মরতে হবেই, মৃত্যু আসবেই, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে না এসে সেই মৃত্যু যখন অচিন্ত্যনীয় আকস্মিকভাবে এসে পড়ে, তখন সত্যিই যেন কেমন বিহুল বিমূঢ় করে দেয়। আবার সেই মৃত্যু যদি স্বাভাবিক না হয়ে নিষ্ঠুর হত্যা হয়, তাহলে যেন কোথাও কোন সান্ত্বনাই খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা অসহায় শূন্যতা যেন চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে।
শিবতোষের মনের অবস্থাটাও ঠিক সেই রকমই হয়েছিল।
কিন্তু সহজে একেবারে ভেঙ্গে পড়বার মত মানুষ ছিলেন না শিবতোষ। বরাবরই তাঁর অসাধারণ মনবল।
অনেকখানি আশা ছিল শিবতোষের নির্বাণীতোষের ওপরে। সেই নির্বাণীতোষ চলে গেল গেল না, কেউ নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করেছে।
কে? কে এমন করে তাকে হত্যা করে গেল? নিঃসন্দেহে তার কোন শত্রু। কিন্তু নির্বাণীতোষের কোন শত্রু ছিল, কথাটা যেন আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ছেলেকে আর শিবতোষ ফিরে পাবেন না ঠিকই, কিন্তু যেমন করেই হোক তাঁকে খুঁজে বের করতেই হবে—এ কাজ কার! কে হত্যা করেছে নির্বাণীতোষকে!
কথাটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একসময় একজনের কথা মনের মধ্যে উদয় হয় শিবতোষের। পুলিস হয়ত কোনদিনই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে পারবে না, তারা হয়ত নিয়মমাফিক খানিকটা অনুসন্ধান চালাবে, তারপর সাধারণত যা ঘটে থাকে তাই ঘটবে, সমস্ত ব্যাপারটাই ফাইল-চাপা পড়ে যাবে।
কিন্তু শিবতোষের তা হলে তো চলবে না। তাঁকে জানতেই হবে হত্যাকারী কে? কেন। সে হত্যা করল? কি অপরাধ করেছিল নির্বাণীতোষ যে তাকে নিহত হতে হল?
কিন্তু কেমন করে হত্যাকারীকে তিনি খুঁজে বের করবেন! ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ সেই মানুষটির কথা মনে পড়ে। বছর দুই পূর্বেপরিচয় হয়েছিল মানুষটির সঙ্গে ঘটনাচক্রেশিবতোষের। তাঁরই এক কর্মচারী তাঁর চেকের, সই জাল করে অনেকগুলো টাকা তাঁর ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিয়েছিল। একবার নয়, চার-পাঁচ মাস ধরে থোকে থোকে প্রায় হাজার ত্রিশেক টাকা তুলে নিয়েছিল।
যে ব্যাঙ্ক থেকে দ্বিজেন অথাৎ সেই কর্মচারীটি টাকা তুলেছিল তাঁর সই জাল করে, সে ব্যাঙ্ক থেকে বড় একটা টাকা তুলতেন না শিবতোষ। মধ্যে মধ্যেই জমা দিতেন কেবল টাকা। শিবতোষের বিশেষ এক পরিচিত ভদ্রলোকের ছেলে ঐ দ্বিজেন দত্ত। সেই ভদ্রলোক হঠাৎ হাইপারটেনশনে অন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং শিবতোষকে অনুরোধ করায় তিনি দ্বিজেনকে নিজের অফিসে চাকরী দিয়েছিলেন, বছর দেড়েক অত্যন্ত সততার পরিচয় দিয়েছিল দ্বিজেন, যাতে করে শিবতোষের বিশ্বাস জন্মায় দ্বিজেনের ওপর।
দ্বিজেনের হাত দিয়ে অনেক সময় টাকা জমা দিয়েছেন এবং ব্যাঙ্ক থেকেও টাকা তুলেছেন চেক দিয়ে, হঠাৎই ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলেন শিবতোষ সেই ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট অফ অ্যাকাউন্ট থেকে, অনেক টাকা থোকে থোকে তোলা হয়েছে ঐ ব্যাঙ্ক থেকে অথচ গত আট-ন মাসের মধ্যে ঐ ব্যাঙ্ক থেকে কোন টাকাই তিনি তোলেননি, সবই ছিল বেয়ারার চেক, এবং খোঁজ নিতে গিয়ে ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষ যখন চেকগুলো পেশ করল, তখন তিনি তো হতবাক। অবিকল তাঁরই সই।
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন শিবতোষ। কে তাঁর সই জাল করে টাকা তুলল। সেই সময়ই এক পরিচিত ভদ্রলোক তাঁকে কিরীটী রায়ের সন্ধান দেন এবং কিরীটী রায়ই শেষ পর্যন্ত জালিয়াতকে ধরে দেয়।
সেই থেকেই জানা-শোনা ও পরিচয়। মানুষটির অদ্ভুত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিল শিবতোষ। হঠাৎ তাঁরই কথা মনে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন এবং তাঁর ঘরে যে নিজস্ব ফোন ছিল, তার রিসিভার তুলে ডায়েল করলেন।
রাত তখন প্রায় তিনটে।
কিছুক্ষণ রিং হবার পরই অপর প্রান্ত থেকে সাড়া এল, কিরীটী রায় কথা বলছি।
কিরীটীবাবু, আমি শিবতোষ মল্লিক—
এত রাত্রে কি ব্যাপার মল্লিক মশাই!
একবার এখুনি দয়া করে আমার বেলতলার বাড়িতে আসবেন?
ব্যাপার কি? হঠাৎ কি হল এখন? আজ রাত্রে তো আপনার বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেয়ে এলাম আপনার একমাত্র ছেলের বৌভাতের—
সেই ছেলে—
কি হয়েছে!
তাকে কেউ খুন করে গেছে।
সে কি!
হ্যাঁ, একবার দয়া করে আসুন, পুলিসও এসেছে—
ঐ সময়ই বীরেন মুখার্জী ও শিখেন্দু ঘরে প্রবেশ করে।
দেরি করবেন না মিঃ রায়, যদি বলেন তো গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। বললেন শিবতোষ মল্লিক।
না না, তার কোন প্রয়োজন নেই, আমি আসছি।
শিবতোষ ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। এবং ঘুরে দাঁড়াতেই বীরেন মুখার্জী ও শিখেন্দুর সঙ্গে চোখাচোখি হল।
বীরেনবাবু দেখলেন? শিবতোষ প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ।
কিছু বুঝতে পারলেন?
আজ তো এ বাড়িতে উৎসব ছিল, অপরিচিত অনেক লোক আসা-যাওয়া করেছে, হত্যাকারী তাদেরই মধ্যে কেউ