শিখেন্দুবাবু? বলুন!
এ-বাড়ির সঙ্গে যখন বিশেষ আপনার পরিচয় অনেক দিন থেকেই আছে এবং আপনি যখন নির্বাণীতোষবাবুর ক্লাসফ্রেণ্ড ছিলেন, ঘটনার সময়ও এখানে উপস্থিত ছিলেন—আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
কি জানতে চান বলুন।
যতদূর জানি শিবতোষবাবুর তো ঐ একমাত্রই ছেলে?
লোকে অবিশ্যি তাই জানে, তবে ব্যাপারটা ঠিক তা নয় কিন্তু—
কি রকম? আর কোন ছেলে আছে নাকি শিবতোষবাবুর?
শিবতোষবাবুর দুই বিয়ে। অবিশ্যি অনেকেই তা জানে না এবং যারা জানত তারাও হয়ত ভুলে গিয়েছে আজ।
সত্যি নাকি!
হ্যাঁ–তাঁর প্রথমা স্ত্রী অবিশ্যি বহুদিন আগেই গত হয়েছেন, এবং শুনেছি, তাঁর মৃত্যুর বছরখানেক পরেই নির্বাণীর মাকে কাকাবাবু দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন।
প্রথমা স্ত্রী তাহলে নেই?
না। শুনেছি কাকাবাবুর এক সহপাঠীর বোন সান্ত্বনাদেবীকে লুকিয়ে বাবা রায়বাহাদুরকে জানিয়ে বিবাহ করেছিলেন।
কার কাছে শুনেছেন কথাটা?
নির্বাণীই একদিন কথায় কথায় বলেছিল।
হুঁ, তারপর?
তারা ছিল অত্যন্ত গরীব মধ্যবিত্ত ছাপোষা গৃহস্থ, কিন্তু সান্ত্বনাদেবী নাকি অপরূপ সুন্দরী ছিলেন। সেই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই–
বুঝেছি–
তাঁর একটি ছেলে হয়—
তাই নাকি!
হ্যাঁ।
তা সে ছেলেটি জীবিত আছে?
আছে—তবে—
তবে?
সে লেখাপড়া কিছুই করেনি—
কি নাম তার?
আশুতোষ। শুনেছি কাকাবাবু তাকে পড়াবার, মানুষ করবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সে কাকাবাবুর কোন সাহায্যই গ্রহণ করেনি। কাকাবাবুর কাছে আসেওনি কখনও। বরাবর সে তার মামাদের কাছেই থাকত।
কি করে আশুতোষ?
শুনেছি জগদ্দলের জুট মিলে কাজ করে এবং সেখানেই মিলের একটা কোয়াটারে থাকে বর্তমানে।
তা আশুবাবুর—তার বাপ শিবতোষবাবুর ওপরে এত বিরাগের কারণই বা কি?
বলতে পারব না।
এ উৎসবে নিশ্চয়ই সে আসেনি?
না।
তাকে দেখেছেন কখনও আপনি?
না।
আপনার বন্ধু নির্বাণীতোষবাবু কখনও দেখেছিলেন তাকে?
সম্ভবতঃ না।
আশুবাবুর প্রতি তার মনোভাব কেমন ছিল জানেন কিছু?
নির্বাণীর মত ছেলে হয় না মিঃ মুখার্জী! যেমন নিরহঙ্কার, তেমনি সরল, তেমনি মিশুঁকে প্রকৃতির মানুষ ছিল সে।
তার মানে, বলতে চান কারুর সঙ্গে কোন শত্রুতারও সম্ভাবনা ছিল না।
না। ঝগড়াঝাঁটি সে কারুর সঙ্গে করেনি। করতে কখনও দেখিনি। তাই তো বুঝে উঠতে পারছি না এখনও মিঃ মুখার্জী, তার মত মানুষের এমন কে শত্রু থাকতে পারে যে তাকে এমন করে খুন করে গেল!
আচ্ছা এ-বাড়ির চাকরবাকররা নিশ্চয়ই সন্দেহের বাইরে?
গোকুল আর রাজেন–না, ওদের দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়। তাছাড়া এ বাড়িতে অনেক বছরই ওরা আছে।
তাঁর বন্ধু-বান্ধব তত ছিল?
তা ছিল।
তাদের মধ্যে বেশী ঘনিষ্ঠতা কার কার সঙ্গে ছিল নির্বাণীতোষবাবুর বলতে পারেন?
সকলের সঙ্গেই ও মিশত, সকলেই ওকে লাইক করত। তবে ঘনিষ্ঠতার কথা যদি বলেন, সঞ্জীব, পরেশ আর নির্মলকান্তির সঙ্গে একটু বেশীই ঘনিষ্ঠতা ছিল বোধ হয়। তারা সবাই আমাদের ক্লাসফ্রেণ্ড। তবে ওদের মধ্যে নির্মল আমাদের সিনিয়র ছিল, এখনও ফাইন্যাল এম.বি. পাস করতে পারেনি। শিখেন্দু বললে।
আর সঞ্জীব ও পরেশবাবু?
তারাও পাস করতে পারেনি।
তারা আজ আসেনি উৎসবে?
সঞ্জীব ও পরেশ এসেছিল, নির্মলকান্তি আসেনি বোধ হয়। কারণ তাকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
কেন? আসেননি কেন নির্মলবাবু?
তা বলতে পারব না।
ঠিক আছে, নীচে চলুন। দীপিকাদেবীকে আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
জ্ঞান হওয়া অবধি সে তো কোন কথাই বলছে না।
কিছুই বলেননি?
না। কোন প্রশ্ন করলে কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
স্বাভাবিক, খুব শক্ পেয়েছেন তো!
বুঝতেই পারছেন একসঙ্গে পড়েছে, দীর্ঘদিনের জানা-শোনা, ঘনিষ্ঠতা—
দীপিকাদেবীও ডাক্তার নাকি?
হ্যাঁ—আমাদের সঙ্গেই পাস করেছে।
চলুন দেখা যাক।
দুজনে নীচে নেমে এল।
স্বাতীর ঘরে একটা চেয়ারের উপরে দীপিকা বসেছিল। পরনে তার এখনও সেই দামী বেনারসী শাড়ি আকাশ-নীল রংয়ের, মাগার সিঁথিতে সিঁদুর, সামনের কিছু বিশৃঙ্খল চুল চন্দন-চৰ্চিত কপালের উপরে এসে পড়েছে, গা-ভর্তি গহনা।
মাথার উপরে পাখাটা বনবন করে ঘুরছে, দাঁড়িয়ে স্বাতী। তার একটা হাত দীপিকার পিঠের উপর ন্যস্ত।
ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে স্বাতী চোখ তুলে তাকাল।
দীপিকা কিন্তু তাকাল না।
স্বাতী!
আসুন শিখেন্দুদা, স্বাতী বললে।
০২. থানার ও সি এসেছেন
থানার ও সি এসেছেন, শিখেন্দু বললে, দীপাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান উনি স্বাতী।
বীরেন মুখার্জী তাকালেন দীপিকার মুখের দিকে।
কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে দীপিকা।
বীরেন মুখার্জী দুপা এগিয়ে গিয়ে একেবারে সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ডাকলেন, দীপিকাদেবী?
দীপিকা কোন সাড়া তো দিলই না, তাকালও না বীরেন মুখার্জীর দিকে, যেন শুনতেই পায়নি সে, কোন শব্দই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি যেন।
দীপিকাদেবী, আমি বুঝতে পারছি, আপনার বর্তমান মনের অবস্থা কি! এও বুঝতে পারছি, আপনাকে এ সময় বিরক্ত করা সমস্ত মানবিকতার বাইরে, তবু বুঝতেই পারছেন আপনার স্বামীর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করবার জন্যই আপনাকে, মনের বর্তমান অবস্থাতেও, বিরক্ত করতে হচ্ছে, কারণ আপনিই প্রথম আবিষ্কার করেন যে আপনার স্বামী ছুরিকাবিদ্ধ হয়ে মৃত রক্তাক্ত অবস্থায় বাথরুমের মেঝেতে পড়ে আছেন।
কিন্তু তথাপি কোন সাড়াই পাওয়া গেল না দীপিকার মধ্যে যেন। কথাগুলো যেন তার কানে প্রবেশই করেনি, প্রস্তরমূর্তির মত যেমন বসেছিল দীপিকা, তেমনই বসে রইল।