বিরাট একটা খাট, দামী শয্যা বিছানো। খাটটা ফুলে ফুলে সাজানো। রজনীগন্ধার মৃদু সুবাস ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
ঘরে কেউ ছিল না।
দীপিকার জ্ঞান হবার পর তাকে স্বাতী ও স্মৃতি নীচে দোতলায় নিয়ে গিয়েছিল।
শিবতোষ মল্লিক শহরের একজন বিশিষ্ট ধনী ব্যক্তি। তাঁর যে কেবল অর্থ ও সম্পদের জন্যই সমাজে তিনি পরিচিত ছিলেন তা নয়, নানা সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি নানাভাবে জড়িত বলে ঐ অঞ্চলে তাঁর একটা বিশেষ পরিচয়ও আছে।
মানুষটিনিরহংকারী সদালাপী ও সহৃদয় বলেপাড়ার সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করেও ভালবাসে। বীরেন মুখার্জীর সেটা জানা ছিল ঐ তল্লাটে থানা-অফিসার হিসাবে। ঐ থানায় বীরেন মুখার্জী বছর দুই হল এসেছেন।
ব্যক্তিগতভাবে শিবতোষ মল্লিকের সঙ্গে বীরেন মুখার্জীর বেশ আলাপও আছে। আজ তাঁর একমাত্র ছেলের বৌভাত উৎসবে নিমন্ত্রিতও হয়েছিলেন, এসেওছিলেন। কিন্তু বেশীক্ষণ থাকতে পারেননি। রাত দশটা নাগাদ চলে গিয়েছিলেন।
নির্বাণীতোষ নিজেই তাঁকে অভ্যর্থনা করে দাঁড়িয়ে থেকে খাইয়েছিল।
ঘরের মধ্যে ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন মুহূর্তের জন্য যেন বীরেন মুখার্জী। এই সুন্দর স্নিগ্ধ পরিবেশে এমন একটি উৎসবের রাত, তারই মধ্যে নিষ্ঠুর মৃত্যু রক্তক্ষরণ করেছে।
পুলিস অফিসার হিসাবে বহুবার তাঁকে এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, কিন্তু আজ যেন ঐ ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে হঠাৎ কেমন বিব্রত বোধ করেন।
শিখেন্দুর মুখের দিকে তাকালেন বীরেন মুখার্জী, শিখেন্দু বাথরুমের খোলা দরজার দিকে
তাকাল।
বীরেন মুখার্জী এগিয়ে গেলেন বাথরুমের দিকে, একটা জল পড়ার শব্দ শোনা গেল।
নিবার্ণীতোষের মৃতদেহটা ঠিক তেমনি ভাবেই পড়েছিল। উপুর হয়ে পড়ে আছে মৃতদেহটা, মুখটা বাঁদিকে কাত করা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মৃতদেহটার দিকে বীরেন মুখার্জী।
ছোরা প্রায় আমূল বিদ্ধ হয়ে আছে বাঁ দিকের পৃষ্ঠদেশে ঠিক স্ক্যাল্লার বর্ডার ঘেঁষে। ছোরাটার বাঁটটা কাঠের।
পকেট থেকে রুমাল বের করে ছোরার বাঁটটা ধরে শক্ত করে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছোরাটা বের করে আনলেন বীরেন মুখার্জী।
ধারাল ছোরার ফলাটা তীক্ষ্ণ।
ছোরাটা টেনে বের করতে গিয়েই বুঝলেন বীরেন মুখার্জী, কত জোরে ছোরাটা বেচারীর পৃষ্টদেশে বেঁধানো হয়েছিল যার ফলে ফলাটার সবটাই প্রায় ঢুকে গিয়েছিল দেহের মধ্যে, হয়ত আঘাতের প্রচণ্ডতার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুও হয়েছে।
কিন্তু যে-ই ছোরাটা মেরে থাকুক, তার হাতের কক্তির জোর নিশ্চয়ই আছে। ছোরাটা খুব ছোট নয়—একেবারে ফলাটা ছ-ইঞ্চি মত হবে, বাঁটটা চার ইঞ্চির মত। সর্বমোট বারো ইঞ্চি মত লম্বা। তীক্ষ্ণ ধার, ইস্পাতের তৈরী ছোরাটা, ফলাটা ঝক্ঝক্ করছে।
বেসিনের ঠিক সামনাসামনিই হাত দেড়েক ব্যবধানে মৃতদেহটা পড়ে আছে। বেসিনের দিকে তাকালেন বীরেন মুখার্জী।
বেসিনের কলটা খোলা, জল পড়ে যাচ্ছে। বেসিনের মধ্যে শূন্য একটা কাঁচের গ্লাস, গ্লাসটা তুলে পাশে রাখলেন বীরেন মুখার্জী। বীরেন মুখার্জী কলের প্যাঁচটা ঘুরিয়ে কলটা বন্ধ করে দিলেন।
বড় সাইজের বাথরুম। বাথরুমের দেওয়ালে চারপাশে একমানুষ সমান উঁচু ইটালীয়ান টাইলস্ বসানো, মেঝেটা মোজাইক করা, বেসিনের সামনে একটা আশী লাগানো দেওয়ালে। তারই নীচে একটা শেফে নানাবিধ পুরুষের প্রসাধন দ্রব্য ও সেভিং সেট সাজানো।
দুটি দরজা বাথরুমের। একটা ঘরের সঙ্গে, অন্যটা বোধ হয় মেথরদের যাতায়াতের জন্য। দরজাটা লক করা ছিল ভিতর থেকে। খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলেন বীরেন মুখার্জী একবার। তাঁর অনুমান মিথ্যে নয়, দরজার বাইরেই সরু বারান্দা এবং ঘোরানো লোহার সিঁড়ি।
নীচে তাকালেন বীরেন মুখার্জী, বাড়ির পশ্চাৎ দিক সেটা, উৎসবের জন্য সেখানেও প্যাণ্ডেল করা হয়েছিল। নীচের প্যাণ্ডেলে তখনও আলো জ্বলছে।
আবার বাথরুমের মধ্যে এসে ঢুকলেন বীরেন মুখার্জী। দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। হঠাৎ ঐ সময় তাঁর নজরে পড়ল ছোট একটা সেলোফেন কাগজের টুকরোর মত বেসিনের নীচেই পড়ে আছে।
কৌতূহলী হয়ে ঝুঁকে পড়ে কাগজটা তুলতেই দেখলেন, দুটো কোড়োপাইরিনের বড়ির একটা ছেড়া স্ট্রীপ। স্ট্রীপটা পকেটে রেখে দিলেন বীরেন মুখার্জী।
বীরেন মুখার্জী বুঝতে পারলেন, ব্যাপারটা যা বোঝা যাচ্ছে নিষ্ঠুর একটা হত্যাই। আততায়ী যে-ই হোক, আজ রাত্রে বাড়িতে উৎসব ছিল, বহু লোকের সমাগম ঘটেছিল, যাওয়া আসার দ্বারও অবারিত ছিল—আততায়ীর পক্ষে কোনই অসুবিধা হয়নি। হয়ত কোন এক ফাঁকে সুযোগ মত ঐ বাথরুমের মধ্যে এসে আত্মগোপন করে থাকতে পারে, তারপর যেই নির্বাণীতোষ বাথরুমে ঢুকেছে, তাকে পিছন থেকে ছোরা মেরে খতম করে আবার এক ফাঁকে ভিড়ের মধ্যে অনায়াসেই সরে পড়েছে।
কাজেই আততায়ীকে খুঁজে বের করা তত সহজ হবে না। তাহলে ও কানুন অনুযায়ী একটা অনুসন্ধান ও এ-বাড়ির সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই হবে।
তবে এটা ঠিক হত্যাকারী যে-ই হোক, এ-বাড়ি সম্পর্কে সে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। সে জানত এ-বাড়ির সব কিছু। শুধু তাই নয়, আরও একটা কথা মনে হয় বীরেন মুখার্জীর, সম্ভবতঃ আততায়ী বা হত্যাকারী হয়ত এ-বাড়ির বিশেষ একজন পরিচিত জনই। অনুসন্ধান সেদিক দিয়েও শুরু করা যেতে পারে।
বাথরুম থেকে বের হয়ে এলেন বীরেন মুখার্জী। শিখেন্দু তখনও ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। শিখেন্দু বীরেন মুখার্জীর দিকে তাকাল।