পাশের ঘরে বসেই কিরীটী তার কাহিনী বলে যেতে লাগল। কাহিনীর শেষাংশ—
বলছিলাম না, ইট ওয়াজ এ মাস্টার প্ল্যান দীপিকাকে না পাওয়ার দুঃখে শিখেন্দু ভেতরে ভেতরে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল, তার ভালবাসা, চাওয়া ব্যর্থ হল—নির্বাণীতোেষ তার ঈপ্সিতাকে তার চোখের সামনে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল! কোন কোন ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষের বিশেষ কোন পুরুষ বা নারীকে ঘিরে ভালবাসা বা কামনা কতখানি স্বার্থপর কতখানি তীব্র হতে পারে এবং তার ফলে তারা যে কতখানি হৃদয়হীন ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে তারই জাজ্বল্যমান প্রমাণ দিয়ে গেল আমাদের শিখেন্দু।
দীপিকা তার হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় শিখেন্দুর মনের অবস্থাটাও ঠিক তাই হয়েছিল। সে মনে মনে নির্বাণীকে পথ থেকে সরাবার প্ল্যান করে। প্ল্যানটা একেবারে নিখুঁত। নির্বাণীতোষকে প্যাণ্ডেল থেকে উপরে চলে যেতে বলে, তাঁর মাথার যন্ত্রণা বলায়। নির্বাণীতোষ ভিতরে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেও পিছনের সিঁড়ি দিয়ে সম্ভবত ওপরে চলে যায় এবং বাথরুমে নির্বাণীর আগেই গিয়ে পৌঁছয়।
নির্বাণী কোডোপাইরিন খাবার জন্য বাথরুমে গ্লাস হাতে এসে ঢুকল এবং যখন সে ট্যাপ থেকে গ্লাসে জল ভরছে, শিখেন্দু পেছন থেকে তাকে ছোরা মারল। নির্বাণী পড়ে গেল। হাতের গ্লাসটা বেসিনের মধ্যে পড়ে চিড় খেয়ে গেল, ট্যাপটা ভোলাই রইল। শিখেন্দু পালাল আবার ঐ লোহার সিঁড়ি দিয়েই। নির্বাণীর রক্তাক্ত ছোরাবিদ্ধ মৃতদেহটা পড়ে রইল। তারপর কিছুক্ষণ বাদে ওপরে এলো দীপিকা। সে সম্ভবত ঘরে ঢুকে ঘরে আলো জ্বলছে দেখে—অথচ তার স্বামীকে ঘরের কোথাও না দেখে তাকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। আমার মনে হয়েছে শিখেন্দু হত্যা করে চলে যাবার আগে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে বাথরুমের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যায়, অবিশ্যি এটাও অনুমান। যাই হোক, স্বামীকে খুঁজতে খুঁজতে বাথরুমের দরজা খোলা দেখে দীপিকা বাথরুমেই ঢোকে এবং আলো জ্বালায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাথরুমে পূর্ব প্ল্যান মত নীল শাড়ি পরে সঞ্জীববাবু ঢোকেন। তার পরেও আমার অনুমান, হয়তো দীপিকাদেবীর দুটো ব্যাপারই একই সঙ্গে চোখে পড়ে, শাড়ি পরা সঞ্জীববাবু ও তাঁর স্বামীর রক্তাক্ত ছোরাবিদ্ধ ভূলুণ্ঠিত মৃতদেহটা। স্বামীর মৃতদেহ ও শাড়ি পরা সঞ্জীববাবুকে চিনতে পেরে এবং দুটোকে একই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে তাঁর মনে হয়—অ্যাণ্ড শী ফেনটেড, ড্রপড অন দি ফ্লোর! সঞ্জীববাবু নিশ্চয়ই বলতে পারবেন, তাই ঘটেছিল কিনা।
সঞ্জীব মৃদু কণ্ঠে বললে, হ্যাঁ। প্রথমেই বাথরুমে ঢুকে দীপার সঙ্গে আমার চোখাচোখি ও তার পরই দুজনেরই আমাদের একসঙ্গে নজরে পড়ে মৃতদেহটা। দীপিকা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় আর আমি সঙ্গে সঙ্গে যে পথে বাথরুমে এসেছিলাম সেই পথেই পালাই তাড়াতাড়ি।
আপনার পালাবার সময় কেউ আপনাকে দেখেছিল?
বোধ হয় শিখেন্দু দেখতে পেয়েছিল, সে তখন নীচে প্যাণ্ডেলেই ছিল। সে ও দীপিকা দুজনেই যদি ভাবে যে আমিই নির্বাণীকে হত্যা করেছি—তাই আমি সেদিন রাত্রে আদৌ আসিনি এখানে আপনাকে বলেছিলাম।
কিরীটী বললে, এখন বুঝতে পারছি আমার আর একটি অনুমানও ঠিক, নীলবসনা কোন নারীই সে রাত্রে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠেনি।
তবে গোকুল যে তার জবানবন্দিতে বলেছিল–বীরেন মুখার্জী বললেন।
গোকুলকে ডাকুন তো!
গোকুলকে ডাকা হল। কিরীটী বললে, গোকুল তুমি মিথ্যা বলেছ।
কি মিথ্যা বলেছি বাবু? গোকুল যেন রীতিমত ভয় পেয়ে গেল।
সে-রাত্রে ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় নীল শাড়ি পরা বৌ ওঠেনি, তাই নয় কি? তবে তুমি ঐ কথা বলেছিলে কেন?
আজ্ঞে–আমি দেখিনি। শিখেদাদাবাবু আমায় বলতে বলেছিলেন তাই পরে ভেবেছিলাম, সত্যি কথাটা বলব কিন্তু ভয়ে বলতে পারিনি। শিখেন্দুদাদাবাবুও বলেছিলেন, সত্যি কথা বলতে গেলে আবার পুলিস আমাকে সন্দেহ করবে—
এখন বলুন তো সঞ্জীববাবু, নারীর বেশে সে-রাত্রে নির্বাণীতোষের ঘরে হানা দেবার প্ল্যানটা কার?
জবাব দিল পরেশ, শিখেন্দুর। সে-ই প্ল্যানটা করেছিল।
এখন তোবুঝতে পারছেন আপনারা, আসলে কোন কৌতুক সৃষ্টির জন্যই নয়—সঞ্জীববাবুর ঘাড়ে হত্যার অপরাধটা চাপানোর জন্যই শিখেন্দু ঐ প্ল্যানটা করেছিল, সত্যিই মাস্টার প্ল্যান! কিন্তু সেদিন যদি ব্যাপারটা একবারও আপনারা কেউ আমাকে খুলে বলতেন, তবে হয়ত সেইদিনই মীমাংসায় আমি পৌঁছতে পারতাম। শিখেন্দুর মনেও সন্দেহ জাগত না,সে পটাশিয়াম সায়ানাইড খাবারও সুযোগ পেত না।
সঞ্জীবকে বাঁচানোর জন্য আমরা মুখ খুলিনি—শিখেন্দুই.পরামর্শ দিয়েছিল। নির্মল ও পরেশ বললে।
কিন্তু তবু দেখলেন তো, পাপ কখনো চাপা থাকে না। শিখেন্দুর দুটি মাত্র মারাত্মক ভুলের জন্যই তার অমন নিখুঁত চতুর প্ল্যানটাও ভেস্তে গেল, পাপ প্রকাশ হয়ে পড়ল।
বীরেন মুখার্জী বললেন, দুটি মারাত্মক ভুল!
হ্যাঁ, কিরীটী বললে, প্রথম ভুল চিৎকার শোনার পর ওপরে এসে শিখেন্দুর বাথরুম দিয়ে ঘরে ঢুকে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে শোবার ঘরের দরজাটা খুলে দেওয়া এবং দ্বিতীয়, দীপিকার অচৈতন্য দেহটা বাথরুম থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া। বাথরুমের দরজাটা যদি সে না বন্ধ করে দিত, আমাদের অন্ধকারেই হাতড়াতে হত কোন্ পথ দিয়ে হত্যাকারী পালালো সে ব্যাপারে এবং সেই সঙ্গে নীলবসনা নারীর ব্যাপারটাও একটা সত্যের আবরণ নিয়ে থেকে যেত। কিন্তু হত্যাকারী নিজের ভুলের জালে নিজেই জড়িয়ে আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক করে দিল। অথাৎ ঐ বাথরুমের বন্ধ দরজা ও দীপিকার শোবার ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা দীপিকার অচৈতন্য দেহটা দেখে শিখেন্দুর মনের দীর্ঘদিনের লালসা তাকে ঘিরে হঠাৎ প্রবল হয়ে ওঠে, সে নিজেকে আর দীপিকাকে স্পর্শ করার লোভটা থেকে সামলাতে পারে না। তাকে বাথরুমের মেঝে থেকে তুলে বুকে করে পাশের ঘরে নিয়ে যায় এবং প্রমাণ করে দিয়েছিল সেটাই আমার কাছে দীপিকার প্রতি শিখেন্দুর গোপন তীব্র আকর্ষণটা। তাছাড়া ভেবে দেখুন মিঃ মুখার্জী, নির্বাণীতোষকে ঐ ভাবে হত্যা করার সুযোগ ঐ রাত্রে সকলের সন্দেহ বাঁচিয়ে একমাত্র নির্বাণীর বন্ধুদের মধ্যে শিখেন্দুরই বেশী ছিল, কারণ সে ছিল এ-বাড়ির সকলের পরিচিত, স্নেহের জন—বিশ্বাসের জন, একপ্রকার ছেলের মত এবং এ-বাড়ির গলিখুঁজি সব তার নখদর্পণে। প্যাণ্ডেলের ভেতরই ছিল লোহার ঘোরানো সিঁড়িটা মেথরদের দোতলা-তিনতলায় যাতায়াতের এবং প্যাণ্ডেলে উপস্থিত থেকে শিখেন্দু সব কিছুর ওপরেই নজর রাখতে পেরেছিল সর্বক্ষণ।