কাকাবাবু!
শিখেন্দুর ডাকে শিবতোষ মুখ তুললেন।
পুলিসে তো একটা খবর দেওয়া দরকার।
পুলিস! কেমন যেন বোকার মতই কথাটা উচ্চারণ করে ফ্যালফ্যাল্ করে তাকিয়ে রইলেন শিবতোষ শিখেন্দুর মুখের দিকে, কথাটা যেন তাঁর আদৌ বোধগম্য হয়নি।
হ্যাঁ, পুলিস,মানে থানায় একটা খবর দেওয়া তো দরকার।
কেন?
মানে, যে ভাবে ওর মৃত্যু হয়েছে, বোঝাই তো যাচ্ছে কেউ ওকে খুন করে গেছে।
খুন করে গিয়েছে, কেন, কে করল? সমস্ত বুকটা নিংড়ে যেন অসহায় বিমূঢ় শিবতোষের মুখ থেকে কথাগুলো বের হয়ে এল কেঁপে কেঁপে।
কেন খুন করল, কে খুন করল নির্বাণীতোষকে তা শিখেন্দুই বা কেমন করে বলবে!
তবু সে বললে, অস্বাভাবিক মৃত্যু, থানায় তো একটা খবর দিতেই হবে।
বেলতলা রোডে শিবতোষের বাড়ি মল্লিক ভিলা, ভবানীপুর থানার আণ্ডারেই পড়ে এবং সেখানকার থানার বড়বাবু অর্থাৎ ও.সি.বীরেন মুখার্জীর সঙ্গে শিবতোষের আলাপও আছে। এদিন রাত্রে বীরেন মুখার্জীও এসেছিলেন উৎসবে নিমন্ত্রিত হয়ে।
শিবতোষের বীরেন মুখার্জীর কথা মনে পড়ল, তিনি বললেন, তাহলে বীরেন বাবুকে একটা ফোন করে দাও, শিখেন্দু।
শিখেন্দু আর কালবিলম্ব করে না, বারান্দায়ই ফোন ছিল, দেয়ালের গায়ে ব্রাকেটের উপর বসানো। এগিয়ে গিয়ে থানায় ফোন করল।
ফোন ধরল থানার ছোটবাবু, ভবানীপুর থানা—
ও.সি, আছেন?
তিনি ওপরে ঘুমোচ্ছেন।
তাঁকে একটু বলবেন এখুনি একবার বেলতলা রোডে মল্লিক ভিলায় আসতে।
ছোটবাবু রণজিৎ সিনহার মল্লিক ভিলাটা ও তাঁর অধিকারী শিবতোষ মল্লিক অপরিচিত নয়। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন, কেন? কি দরকার?
দেখুন এ বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে—
ঐ বাড়িতে তো আজ উৎসব ছিল—
হ্যাঁ, তাঁর ছেলের বৌভাত ছিল—
তা হঠাৎ আবার কি দুর্ঘটনা ঘটল?
তাঁর ছেলে—
কি হয়েছে তাঁর?
সে মারা গেছে।
মারা গেছে নির্বাণী–তোষবাবু! শিবতোষবাবুর একমাত্র ছেলে!
হ্যাঁ।
কি করে মারা গেল? কি দুর্ঘটনা ঘটল? কখন?
সে তো বলতে পারব না—ঘণ্টা দুই আগে তিনতলায় তার শোবার ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে তাকে ছোরাবিদ্ধ মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে—
সে কি–কি বলছেন!
হ্যাঁ। ও.সি.-কে পাঠিয়ে দিন, না হয় আপনিই একবার আসুন।
এখুনি আসছি।
শিখেন্দু ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
কেউ বারান্দায় নেই।
সবাই শিবতোষবাবুকে ঘিরে তখনও তাঁর ঘরের মধ্যেই নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে।
মিনিট কুড়ির মধ্যেই বীরেন মুখার্জী, থানার ও.সি. নিজেই এসে হাজির হলেন। ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশের মধ্যে, অত্যন্ত কর্মঠ ও তৎপর একজন অফিসার। এতদিন তাঁর প্রমোশন হওয়া উচিত ছিল, বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের সুনজরে না থাকার দরুন আজ পর্যন্ত কোন প্রমোশনই হয়নি। তার জন্য বীরেন মুখার্জীর অবিশ্যি কোন দুঃখও নেই। লম্বা চওড়া বেশ বলিষ্ঠ গঠন।
জীপের শব্দ শুনে শিখেন্দুই নীচে নেমে এসেছিল, তার সঙ্গেই প্রথমে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল বীরেন মুখার্জীর, গেটের ভিতরে ঢুকে জীপ থেকে নামতেই।
দুপাশে বিরাট লনে তখনও প্যাণ্ডেলের মধ্যে আলো জ্বলছে।
বীরেন মুখার্জী বললেন, শিবতোষবাবু কোথায়?
চলুন ওপরে দোতলায়, তাঁর ঘরে— আপনি কে?
আমি এ বাড়ির কেউ নই—শিবতোষবাবুর বাল্যবন্ধু সুখেন্দু বিশ্বাসের ছেলে আমি আমার নাম শিখেন্দু বিশ্বাস।
উৎসবের ব্যাপারেই বোধ হয় এসেছিলেন আপনি?
নির্বাণীতোষ আমার ক্লাসফ্রেণ্ড, একসঙ্গেই আমরা ডাক্তারী পাস করেছি। গত দশদিন থেকেই এ বাড়িতে আমি আছি।
নির্বাণীতোষবাবু আপনার ক্লাসফ্রেণ্ড ছিলেন?
হ্যাঁ।
ফোন করেছিল কে থানায়?
আমিই।
চলুন–বীরেন মুখার্জী একজন কনস্টেবলকে নীচে রেখে অন্য একজনকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগুলেন।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই বীরেন মুখার্জী প্রশ্ন করলেন, মৃতদেহ ডিসটার্ব করা হয়নি তো?
না। তিনতলায় তার ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যেই এখনও আছে, শিখেন্দু বললে।
দুদিনের খাটাখাটুনির ক্লান্তিতে যারা হাঁপ ছেড়ে বিশ্রামের জন্য শয্যা নিয়েছিল, তারা সবাই একে একে জেগে উঠেছে ততক্ষণে। বাড়িতে উৎসব উপলক্ষে দুই মেয়ে এসেছে, বড় মেয়ে স্মৃতি—তার জামাই বীরেন, ছোট মেয়ে স্বাতী—তার জামাই ভবেশ, শিবতোষের একমাত্র বোন রাধারাণী—তার ছোট ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে এসেছে, ভগ্নীপতি সমরবাবু আসতে পারেন নি।
তাছাড়া চাকর ও দাসীরা। তাদের মধ্যে দুজন ভৃত্য অনেক দিন ধরেই শিবতোষের গৃহে আছে, গোকুল আর রাজেন। দাসী বেলা, রাঁধুনীবামুন নরেন আর শিবতোষের গৃহ-সরকার যতীশ সামন্ত।
যতীশ সামন্তও বছর দশেক আছেন ঐ বাড়িতে। বয়েস হয়েছে তা প্রায় পঞ্চাশ বাহান্ন। অকৃতদার মানুষ, ঐ বাড়ির নীচের তলাতেই একটা ঘরে থাকেন।
অন্যান্য দূর ও নিকট-সম্পর্কের আত্মীয় যারা এসেছিল, তারা উৎসব চুকে যাবার পর যে যার গৃহে চলে গিয়েছিল।
সবাই জেগে উঠেছিল। সবাই দুঃসংবাদটা শুনেছিল।
সবাই যেন সংবাদটা শুনে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই বাড়িটাও একেবারে স্তব্ধ।
যতীশ সামন্তই সংবাদটা পেয়ে সানাইওয়ালাদের থামিয়ে দিয়েছিলেন।
বাড়িতে কে কে আছেন? বীরেন মুখার্জী জিজ্ঞাসা করলেন।
শিখেন্দুই বলে গেল কে কে আছে।
শিবতোষবাবুর সঙ্গে দেখা করবেন? শিখেন্দু প্রশ্ন করে।
না। আগে চলুন ডেডিটা দেখে আসি। বীরেন মুখার্জী বললেন।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে তিনতলার বারান্দা অতিক্রম করো দুজনে গিয়ে নির্বাণীতোষের শয়নকক্ষে প্রবেশ করল।