একটু কৌতুক করবার জন্য—ক্ষীণ গলায় বললে সঞ্জীব।
কৌতুক!
হ্যাঁ, কথা ছিল আমি বাথরুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকব-নির্বাণী ও দীপা ঘরে এসে খিল দিলে আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে আসব। এসে—
বলুন, থামলেন কেন?
নির্বাণীর সঙ্গে অভিনয় করে চলব, এই তোমার যদি মনে ছিল নির্বাণী, আমাকে ভালবেসে মজাতে গিয়েছিলে কেন? Just a fun—কিরীটীবাবু, just a fun!
আপনার ঐfun বা কৌতুকের পরিকল্পনাটা আপনার অন্যান্য বন্ধুরা জানতেন? বলেছিলেন তাঁদের?
জানত–সবাই জানত, পরামর্শ করেই আমরা পরিকল্পনাটা করেছিলাম।
সে-রাত্রে কখন এসেছিলেন আপনি?
রাত তখন সাড়ে এগারোটার পরই হবে, সঞ্জীব বললে, বোধ হয় পৌনে বারোটা।
কোন্ পথ দিয়ে আপনি ওপরে গিয়েছিলেন?
বাগানের দিকে বাড়ির পিছনে মেথরদের যাঅয়াতের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে।
কি–কি বললেন? ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে পিছন দিককার?
হ্যাঁ।
কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠে যদি দেখতেন বাথরুমের দরজা বন্ধ, তবে বাথরুমে ঢুকতেন কি করে?
শিখেন্দু বলেছিল, দরজাটা সে খুলে রেখে দেবে
কিন্তু আমি—আমি দরজাটা খুলে রাখবার কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। মনেই ছিল না কিরীটীবাবু কথাটা। বিশ্বাস করুন, আমি দরজা খুলে রাখিনি।
জানি আপনি রাখেননি, নির্বাণীতোষ নিজেই খুলে রেখেছিলেন সন্ধ্যা থেকে—কিরীটী বললে।
পরেশ বলল, নিবণী খুলে রেখেছিল!
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন? সে তো জানত না আমাদের প্ল্যানটা?
বলতে পারেন তাঁর নির্মম ভাগ্যই তাঁকে দিয়ে দরজাটা খুলিয়ে রেখেছিল সে-রাত্রে। কিন্তু সঞ্জীববাবু, আপনি বাথরুমে ঢুকে কি দেখেছিলেন? বলুন, গোপন করবেন না কারণ আমি জানি আপনি কি দেখেছিলেন। কিরীটীর স্বর স্পষ্ট ও কঠিন।
সঞ্জীবের সমস্ত মুখ যেন রক্তহীন ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। সে কেমন অসহায় বোবা দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে আছে। সে কথা বলতে পারছে না। ঠোঁট দুটো তার কাঁপছে, আমি–আমি—
আমি বলছি, আপনি কি দেখেছিলেন, সঞ্জীববাবু, আপনার বন্ধু রক্তাক্ত অবস্থায় বাথরুমের মেঝেতে পড়ে আছেন বলুন, তাই দেখেননি?
হ্যাঁ। সেই দৃশ্য দেখে আমি এমন ঘাবড়ে যাই যে—
যে পথে এসেছিলেন সেই পথেই পালিয়ে যান আবার পরমুহূর্তেই!
হ্যাঁ।
কোথায়, কোথায় যান সোজা বেলতলার বাড়ি থেকে?
ক্লাবে। সেখান থেকে বেশ বদলে মেসে যাই।
তাই ফিরতে আপনার মেসে সে-রাত্রে এত দেরি হয়েছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পৌনে এগারোটায় যদি নির্বাণীতোেষ ওপরে গিয়ে থাকেন, তিনি খুন হয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে। বাথরুমে ঢুকে মাথা ধরার জন্য যখন কোডোপাইরিন ট্যাবলেট হাতে জলের গ্লাস নিয়ে বেসিনের সামনে গিয়ে বেসিনের ট্যাপ থেকে জল ভরছিলেন, ঠিক সেই সময়েই অতর্কিতে পিছন থেকে ছোরার আঘাতে—
পরেশ বললে, তবে কি
হ্যাঁ পরেশবাবু, বাথরুমের স্ক্রিনের আড়ালে হত্যাকারী যেন ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হয়ে ছিল, কারণ সে জানত নির্বাণীতোষ ওপরে আসবে এবং বাথরুমেও আসাটা তার স্বাভাবিক শোবার আগে
কে–কে সেই হত্যাকারী। শিখেন্দু ভাঙা গলায় যেন চঁচিয়ে উঠল।
এখনও—এখনও বুঝতে পারলেন না শিখেন্দুবাবু, নির্বাণীতোষের হত্যাকারী কে?
কে?
সে জানত নির্বাণীতোষের শয়নঘরের দরজা বন্ধ, তাই পিছনের বারান্দা দিয়ে বাথরুমের খোলা দরজাপথে ঘরে ঢুকে শয়নঘরের দরজাটা খুলে দিয়েছিল এবং বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল! আপনি—শিখেন্দুবাবু, ইট ওয়াজ ইউ! অ্যাণ্ড ইট ওয়াজ দি মোস্ট আনকাইণ্ডেস্ট অফ ইউ!
অকস্মাৎ ঘরের মধ্যে যেন একটা মৃত্যুর স্তব্ধতা নেমে এসেছে।
পালাবার চেষ্টা করবেন না শিখেন্দুবাবু, কারণ বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিসে। সন্দেহটা প্রথম থেকেই আপনাকে ঘিরেই আমার মনের মধ্যে দানা বেঁধে উঠেছিল। সে-রাত্রে ফোনে সংবাদ পেয়ে এখানে এসে সব দেখেশুনে কিন্তু একটা—একটা ব্যাপার সব কিছুকে যেন জট পাকিয়ে দিচ্ছিল, ঐ জটটা আমি কিছুতেই খুলতে পারছিলাম না।
কিন্তু জটটা খুলে গেল গতসন্ধ্যায় স্বাতীদেবীর স্বীকারোক্তির পরে এবং জটটা হচ্ছে—আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না বাথরুমের দরজাটা বন্ধ ছিল কেন, ওটা তো–
কিরীটীর কথা শেষ হল না, শিখেন্দুর দেহটা চেয়ার থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেল। সশব্দে হঠাৎ।
কি হল, কি হল! সকলেই বলে ওঠে।
ছুটে গেল সবাই শিখেন্দুর ভূলুষ্ঠিত দেহটার কাছে। শিখেন্দুর দেহটা শেষবারের মত আক্ষেপ করে তখন একেবারে স্থির হয়ে গিয়েছে।
বীরেন মুখার্জী পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছেন ততক্ষণে। ডাঃ বর্মণই পরীক্ষা করে বললেন, হি ইজ ডেড
বীরেন মুখার্জী বললেন, ডেড!
হ্যাঁ, খুব সম্ভবত পটাশিয়াম সায়ানাইড-ডাঃ বর্মণ বললেন।
কিরীটী ক্লান্ত গলায় বললে, এ একপক্ষে ভালই হল। নিদারুণ অপমান আর লজ্জার হাত থেকে উনি নিজেকে সরিয়ে দিলেন।
বীরেন মুখার্জী বললেন, কিন্তু আসামী ফাঁকি দিল–
ধরলেও আপনারা প্রমাণ করতে পারতেন না মিঃ মুখার্জী যে শিখেই নির্বাণীতোষকে সে-রাত্রে হত্যা করেছিল!
কেন?
প্রমাণ—প্রমাণ পেতেন কোথায়? কারণ হত্যার আগে বা পরে কেউ ওকে বাথরুমের মধ্যে দেখেছে, এমন কথা তো বলতে পারত না হলফ করে। ইট ওয়াজ এ মাস্টার প্ল্যান। নিজের দীর্ঘদিনের বন্ধু নির্বাণীতোষকে নিজের পথ থেকে সরাবার জন্য শিখেন্দুবাবু যে প্লান করেছিলেন সেটা ছিল একেবারে নিখুঁত। কিন্তু হত্যা করবার পর স্মৃতিভ্রংশ দীপিকার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিল তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। দীপিকাকে লাভ করা তার কোন দিনই সম্ভব হবে না। যোগ-বিয়োগে প্রকাণ্ড ভুল হয়ে গিয়েছে—আর সেই হতাশার বেদনা, আশাভঙ্গের দুঃখটাই যেন আমি সে-রাত্রে এখানে এসে ওর চোখেমুখে দেখেছিলাম। যেটা মনে হয়েছিল তখুনি আমার, বন্ধুবিচ্ছেদ বা বন্ধুর মৃত্যুজনিত দুঃখ নয় সেটা। অন্য কিছু সামথিং এলস! আমার মনে সন্দেহও তখুনি উঁকি দেয় ওকে ঘিরে—কিন্তু এ ঘরে আর নয়, চলুন পাশের ঘরে যাওয়া যাক। বীরেনবাবু, ডেড় বডিটা এ ঘর থেকে সরাবার ব্যবস্থা করুন।