বলে দিয়েছি, সবাই তো বলেছে আসবে ঠিক দশটাতেই। শিখেন্দু মৃদু গলায় জবাব দিল। ঘরের কোণে রক্ষিত স্ট্যাণ্ডের একটিমাত্র আলোর জন্য অত বড় ঘরটা যেন ঠিক ভালভাবে আলোকিত হয়ে উঠতে পারেনি। দীপিকা যেখানে বসেছিল, তারই অল্প দূরে চারটি চেয়ার রাখা ছিল। কিরীটী শিখেন্দুকে বলল, ঐ যে শিখেন্দুবাবু, চেয়ার রয়েছে, বসুন।
শিখেন্দু একবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল, তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে ডানদিককার শেষ চেয়ারটায় বসল।
বাথরুমের আলোটা কিন্তু উজ্জ্বল।
শিখেন্দু আসবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পরেশ আর নির্মল এসে ঘরে ঢুকল। তারা ঘরে ঢুকেই যেন থমকে দাঁড়াল। দুজনেই চারদিকে তাকাল।
বসুন। পরেশবাবু নির্মলবাবু, শিখেন্দুবাবুর পাশেই বসুন। সঞ্জীববাবু কই? তিনি এলেন না?
জবাব দিল পরেশ, সে তো আমাদের আগেই বের হয়েছে। এখনও এল না কেন বুঝতে পারছি না তো। কিন্তু আমাদের আজ রাত্রে এভাবে সকলকে আসতে বলেছেন কেন কিরীটীবাবু?
আজ এখানে এই ঘরে সনাক্তকরণ করব।
নির্মল শুধাল যেন প্রায় বোজা গলায়, সনাক্ত করবেন!
হ্যাঁ।
কাকে?
হত্যাকারীকে—
কিরীটীর ওপ্রান্ত হতে শব্দটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সঞ্জীব এসে ঘরে প্রবেশ করল। কথাটা তারও কানে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
বসুন, সঞ্জীববাবু!
সঞ্জীব চারদিকে একবার তাকাল, তারপরই নজরে পড়ল অল্প দূরে চারটি চেয়ার। তার তিনটিতে পাশাপাশি বসে শিখেন্দু, পরেশ ও নির্মল। নির্মলের পাশের চেয়ারটা খালি।
সঞ্জীব বসে না, কেমন যেন ইতস্তত করে।
কি হল সঞ্জীববাবু, বসুন! নির্মলবাবুর পাশের চেয়ারটায় বসুন। ওটা আপনার জন্যই রাখা আছে।
সঞ্জীব কেমন যেন শিথিল পায়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারটার উপর বসে পড়ল।
শিখেন্দুবাবু পরেশবাবু নির্মলবাবু সঞ্জীববাবু আপনারা চারজন নির্বাণীতোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, কিরীটী বলতে থাকে, আর আপনাদের পাঁচজনেরই সঙ্গে পরিচয় ছিল ঐ যে সামনে বসা দীপিকা দেবী আজ যিনি নির্মম এক নিষ্ঠুরতায় অতীতের স্মৃতি হারিয়ে একেবারে বলতে পারেন বোবা হয়ে গিয়েছেন, বেঁচে নেই—জীবন্মৃত–
সবাই চুপ, কারো মুখেই কথা নেই।
কিরীটী আবার বলল, আমি আশা করেছিলাম হত্যাকারীকে আপনারা ধরিয়ে দেবেন, কারণ দীপিকাকে আপনারা সকলেই মনে মনে এক সময় বাসনা করেছেন
না, না। সঞ্জীব বলে ওঠে।
পরেশ প্রতিবাদ জানায়, মিথ্যা বলিস না সঞ্জীব, আমরা পাঁচজনেই মনে মনে দীপাকে চেয়েছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দীপা নির্বাণীর গলাতেই মালা দিয়েছিল, কারণ দীপা ভালবাসত একমাত্র নির্বাণীকেই।
কিরীটী বলল, ঠিক। এবং সহজভাবেই ব্যাপারটা নেওয়া উচিত ছিল আপনাদের, কিন্তু তা নিতে পারলেন না—
সঞ্জীব বলে ওঠে, বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, সহজভাবেই নিয়েছিলাম অন্তত আমি ব্যাপারটা–
তাই যদি হবে সঞ্জীববাবু, আপনি আমার কাছে মিথ্যে স্টেটমেন্ট দিলেন কেন?
মিথ্যে স্টেটমেন্ট দিয়েছি!
হ্যাঁ, দিয়েছেন।
না। সত্যিই বলেছি।
কিন্তু সঞ্জীবের কথা শেষ হল না, এক নীলবসনা নারী খোলা দরজাপথে ঘরে এসে ঢুকল।
সঞ্জীব ঘেমে গিয়েছে ততক্ষণে। বাকি তিনজনের মুখেও কোন কথা নেই। কেবল দীপিকা মাথা নীচু করে বসে আছে।
নীলবসনা নারী সোজা বাথরুমের মধ্যে গিয়ে ঢুকল, তারপরই হঠাৎ দপ দপ করে ঘরের সব কটা আলো জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দীপিকা মুখ তুলল।
কিরীটী বললে, আসুন, বের হয়ে আসুন!
সেই নীলবসনা নারী একপ্রকার ছুটেই বাথরুম থেকে বের হয়ে দীপিকার সামনে দিয়ে দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজাপথে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল—আর সঙ্গে সঙ্গে অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ গলায় চেচিয়ে উঠল দীপিকা, ধর ওকে, ধর বলতে বলতে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
কিরীটী দীপিকাকে পরীক্ষা করে বললে, নার্স, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন, আসুন ধরুন ওঁকে, তুলে বিছানায় শুইয়ে দিই।
কিরীটী মাথার দিকটা ধরল, নার্স ও স্বাতী পায়ের দিক ধরে দীপিকাকে তুলে শয্যায় শুইয়ে দিল।
যান, পাশের ঘরে ডাঃ বর্মণ আছেন তাঁকে ডেকে আনুন।
সবাই চুপ, সবাই যেন বোবা। ডাঃ বর্মণকে ডাকতে হল না, তিনি নিজেই এসে ঘরে ঢুকলেন।
আপনার পেসেন্টকে পরীক্ষা করে দেখুন ডাক্তার!
ডাঃ বর্মণ দীপিকার পাল্টা একবার পরীক্ষা করলেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন, She is alrightমনে হচ্ছে মিঃ রায়, আপনার experiment successful! জ্ঞান ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর পূর্বস্মৃতি আবার ফিরে পাবেন। নার্স সোডিয়াম গার্ডিনল ইনজেকশনটা এঁকে দিয়ে দাও। রেডি করাই আছে পাশের ঘরে ট্রের ওপরে। নার্স চলে গেল পাশের ঘরে এবং সিরিঞ্জটা হাতে নিয়ে এসে ইনজেকশনটা দিয়ে দিল। ঠিক আছে, ডাঃ বর্মণ বললেন, now let her sleep for 2/3 hours! ঘুম ভাঙবার পর নিশ্চয়ই আমরা দেখতে পাব উনি পূর্বস্মৃতি ফিরে পেয়েছেন। আমি কি চলে যাব এবারে, মিঃ রায়? আমার কিন্তু নাটকের শেষ দৃশ্যটা দেখতে ইচ্ছে করছে if you allow me please!
থাকুন আপনি। তপনবাবু? বলে উচ্চকণ্ঠে ডাকল কিরীটী।
নীলবসনা নারী ঘরে এসে ঢুকল।
আপনি ঐ মেয়ের পোশাক ছেড়ে নিজের জামাকাপড় পরতে পারেন এবারে।
তপন চলে গেল আবার পাশের ঘরে।
সবাই নিবক, সবাই বোবা। যেন পাথর চার বন্ধু শিখেন্দু, পরেশ, নির্মল, সঞ্জীব।
এবারে সঞ্জীববাবু বলুন,সে রাত্রে কেন নারীর বেশ ধরে এখানে এসেছিলেন?