তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন আরও কিছু সংবাদ আছে! কৃষ্ণা বলল।
হ্যাঁ কৃষ্ণা, হত্যাকারী আর অস্পষ্ট নেই—সে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমার সামনে এতক্ষণে। সন্দেহটা আমার গোড়া থেকেই হয়েছিল–কিন্তু ঐ নীলবসনা নারী, সে-ই সব যেন কেমন গোলমাল করে দিচ্ছিল।
নীলবসনা নারী কে ছিল বুঝতে পেরেছ?
অনুমান করতে পেরেছি বৈকি, এবং তার আইডেনটিফিকেশানেরও সব ব্যবস্থা করেছি। অহল্যার ঘুম ভাঙানোর জন্য কিন্তু এখন মনে হচ্ছে—
কি গো?
অহল্যার ঘুম ভাঙা মানেই তো নিদারুণ আর এক আঘাত তার বুক পেতে নিতে হবে।
তোমার কি মনে হয় হত্যাকারীকে সে চিনতে পেরেছিল?
সম্ভবত নয়। কারণ হত্যাকারী সে-সময় তার ধারেকাছেও ছিল না।
তবে?
ঐ ভাবে আকস্মিক স্বামীর রক্তাক্ত ছোরাবিদ্ধ মৃতদেহটাই তাকে এমন আঘাত হেনেছিল যে সেটা সে সহ্য করতে পারেনি। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় ওঁ মনের ভারসাম্য হারায়।
ঐ সময় ঘরের কোলে টেলিফোনটা বেজে উঠল।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল, কিরীটী রায়—
আমি শিখেন্দু বলছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন! সংবাদ পেয়েছেন?
হ্যাঁ।
নবীন অপেরাতেই দেখা পেলেন?
না। সেখান থেকে তার ঠিকানা যোগাড় করে কুমোরটুলিতে তার বাসায় গিয়ে দেখা করি। পাইকপাড়া স্পোর্টস ইউনিয়ন ক্লাবের এক সময় মেম্বার ছিল তপন শিকদার। সে-সময় ওদের ক্লাবে বরাবরই রোল করেছে। তারপর বছর দুই হল তপন নবীন অপেরায় জয়েন করেছে
আপনি সে-রাত্রির কথা বলুন।
সে-রাত্রে সঞ্জীব তাদের ক্লাবের বহ্নিশিখা বইতে আদৌ নামেনি—
তাই নাকি!
হ্যাঁ। অথচ প্লের দিন স্থির হয়ে গিয়েছে, তাই তখন সে তপন শিকদারকে গিয়ে ধরে রোলটা করে দেবার জন্য।
তারপর?
তপন একশো পঁচিশ ডিমাণ্ড করে। শেষটায় একশোতে রাজী করায় সঞ্জীব কে পঞ্চাশ টাকা অ্যাডভান্স করে দেয়, কথা ছিল বাকি টাকা সে প্লে শেষ হবার পর পাবে। ওদের ক্লাবের সেক্রেটারী সেকথা জানত না। তিনি ভেবেছিলেন, তপন শিকদার ক্লাবের একসময় মেম্বার ছিল, বিনি পয়সাতেই একটা রাত্রি প্লে করে দিচ্ছে—তাই প্লের পর টাকা চাওয়ায় সেক্রেটারী তাকে টাকা দেয়নি। বলেছিল, সঞ্জীবের সঙ্গে কথা বলে টাকা দেবে—
ঠিক আছে, বাকি যা বলেছিলাম তার ব্যবস্থা করেছেন?
হ্যাঁ।
নীল শাড়ি যোগাড় হয়েছে?
সে হয়ে যাবে।
তা হলে মনে থাকে যেন, কাল রাত দশটায় যেমন বলেছি, তপনবাবুকে নীল শাড়ি পরিয়ে নিয়ে আসবেন শিবতোষবাবুর বেলতলার বাড়িতে।
বেশ।
শুধু আপনি একা নয় কিন্তু—
তবে?
সঞ্জীববাবু, নির্মলবাবু ও পরেশবাবুকেও সঙ্গে আনবেন।
তাদের কি বলব?
বলবেন আমি আসতে বলেছি, কাল রাত দশটায় নির্বাণীবাবুদের বেলতলার বাড়িতে। আরও একটা কথা, সদর দিয়ে কিন্তু বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করবেন না।
তবে? কোথা দিয়ে ঢুকব?
বাড়ির পেছনে যে গোপন লোহার সিঁড়িটা আছে, সেই সিঁড়ি দিয়ে সোজা আপনারা নির্বাণীবাবুর শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকবেন তিনতলায়। বাথরুমের দরজা খোলা থাকবে, বারান্দার ভেতর দিয়ে ঢুকবেন।
শিখেন্দু কোন সাড়া দেয় না।
শিখেন্দুবাবু, বুঝতে পেরেছেন প্ল্যানটা আমার?
পেরেছি। কিন্তু এসব কেন করছেন তা তো বললেন না!
আমার স্থির বিশ্বাস—
কি?
যে আয়োজন আমরা করেছি, তাতে করে অহল্যার ঘুমও ভাঙবে–হত্যাকারীর মুখোশটাও তার মুখ থেকে খুলে যাবে।
আপনি সত্যিই তাই মনে করেন কিরীটীবাবু?
এখন আর কথা নয় শিখেন্দুবাবু, আমার কিন্তু কাজ এখনো বাকি আছে। সেগুলো আমায় শেষ করতে হবে। কাল দেখা হবে রাত দশটায়।
১০. পরের দিন রাত্রে
পরের দিন রাত্রে। দশটা বাজতে তখনও কিছু সময় বাকি আছে।
বেলতলায় শিবতোষের বাড়ির তিনতলার সেই ঘর। আসবাবপত্র যেমন যেখানে ছিল তেমনি আছে। কেবল সে-রাত্রের মত ফুলের সমারোহ নেই। ঘরের মধ্যে যেন একটা করুণ স্তব্ধতা বিরাজ করছে। ঘরের মধ্যস্থলে একটি চেয়ারের উপরে দীপিকা উপবিষ্ট। এবং সে-রাত্রে ঘরে ছিল উজ্জ্বল আলোআজ একটি মাত্র আলো ঘরের কোণে জ্বলছে। দীপিকার পূর্বস্মৃতি এখনো ফিরে আসেনি। সে এখনো নিজীব। নিজের থেকে কোন কথা বলে না, হাসে না, কাঁদে না, এমন কি ক্ষুধা পেলে খাওয়ার কথাও বলতে পারে না। ডাঃ বর্মণ শিবতোষকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, দীপিকাকে কোন নার্সিং হোমে ভর্তি করে দেবার জন্য। শিবতোষও অসম্মত ছিলেন না, কিন্তু কিরীটী তাঁকে বলেছিল, কটা দিন অপেক্ষা করুন, তারপর ডাঃ বর্মণ যেমন বলেছেন তাই করা যাবে। তাছাড়া দীপিকাও সর্বক্ষণ শান্ত চুপচাপই রয়েছে, বরং কিছুদিনের জন্য কিরীটীর পরামর্শে দীপিকার দেখাশোনার জন্য দুজন নার্স রাখা হয়েছিল রাত্রি ও দিনের জন্য। আর স্বাতীকেও যেতে দেয়নি কিরীটী। স্মৃতি দিল্লীতে থাকে, সে তার স্বামীর সঙ্গে দিল্লী চলে গিয়েছে।
পরেশ ভৌমিক নিজেও বলেছেন, কিরীটীবাবু যতদিন বলবেন তুমি বরং তোমার বৌদির সঙ্গে এই বাড়িতে থাক।
ঘরের মধ্যে চেয়ারে উপবিষ্ট দীপিকার পাশেই দাঁড়িয়েছিল রাত্রির নার্স ও স্বাতী। কিরীটী ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিল আর ঘন ঘন নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল।
বাথরুমের মধ্যে আলো জ্বলছে—মেথরের যাতায়াতের দরজাটা বাথরুমের মধ্যে খোলাই রাখা হয়েছে—কিরীটীর নির্দেশমত।
বাথরুমের মধ্যে মৃদু পদশব্দ শোনা গেল।
কিরীটী বাথরুমের দরজার দিকে তাকাল, শিখেন্দু এসে ঘরে প্রবেশ করল।
আসুন, শিখেন্দুবাবু! পরেশবাবু নির্মলবাবু সঞ্জীববাবু তাঁরা আসেন নি? কিরীটী প্রশ্ন করল।