মিথ্যা স্টেটমেন্ট! কিরীটী তাকাল পরেশ ভৌমিকের মুখের দিকে।
হ্যাঁ, স্বাতীয়ে বলেছিল, ওদের বৈমাত্রেয় ভাই, ঐদিন উৎসবের রাত্রে—
কিরীটী বাধা দিয়ে বললে, হ্যাঁ, উনি বলেছিলেন ওঁদের বৈমাত্রেয় ভাই আশু মল্লিককে কখনও উনি বেলতলার বাড়িতে আসতে দেখেননি। উনি যে সত্য গোপন করেছিলেন সেটা আমি বুঝতে পেরেছি পরে।
পেরেছেন বুঝতে?
হ্যাঁ, আগের কথা বলতে পারি না, তবে উৎসবের রাত্রে যে আশু মল্লিক এসেছিলেন সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। আর এও বুঝেছিলাম, অন্য কোনদিন না দেখলেও সে রাত্রে উনি বুঝতে পেরেছিলেন ঐ অচেনা আগন্তুকই ওঁর বৈমাত্রেয় ভাই। আপনার যদি আপত্তি না থাকে স্বাতীদেবী, এবার বলুন সে-রাত্রে কখন কোথায় দেখেছিলেন তাঁকে আর চিনতেই বা পারলেন কি করে তাঁকে যে তিনি আপনাদের বৈমাত্রেয় ভাই?
বল স্বাতী, আমাকে যা বলেছ তা ওঁকে বল। ব্যাপারটা একটা জঘন্য মাডার কেস, প্রত্যেক সমাজ-সচেতন ব্যক্তিরই কর্তব্য দেশের আইনকানুনকে সাহায্য করা নিজ নিজ সাধ্যমত। ইট ইজ ইওর ডিউটি, স্পিক আউট!
স্বাতী তখন যা বললে—
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ সে একবার উপরে গিয়েছিল, দু-চার-পাঁচ মিনিট হয়ত আগেই। দীপিকার চশমাটা আনতে ওপরের ঘর থেকে। বৌ সাজাবার পর দীপিকা চশমাটা পরতে ভুলে গিয়েছিল। পরে তাকে ঘরে এনে বসিয়ে দেবার ঘন্টা-তিনেক পরে কষ্ট হতে থাকায় শেষ পর্যন্ত স্বাতীকে বলে ওপরে গিয়ে চশমাটা নিয়ে আসার জন্য। সেই চশমাটা আনতেই স্বাতী ওপরে গিয়েছিল। ঘরের দরজা খোলা এবং ঘরে আলো জ্বলতে দেখে স্বাতী একটু অবাকই হয়। হঠাৎ ওর কানে আসে ঘরের মধ্যে তার দাদা যেন কার সঙ্গে কথা বলছে।
দাদার কথা নিশ্চয়ই শুনেছিলেন আপনি? কিরীটীর প্রশ্ন।
হ্যাঁ, দাদা যেন কাকে বলছিল, নিশ্চয়ই দেব দাদা, তোমার আশীর্বাদ দীপাকে আমি নিজেই পরিয়ে দেব। কিন্তু তুমিও তো নিজের হাতে তাকে দিতে পার, সে সব জানে—তাকে ডেকে আনব নীচে থেকে?
তারপর?
জবাব এল ভারী গম্ভীর গলায়, না না—তার কোন দরকার নেই ভাই। তুমি তাকে দিও আমার নাম করে। এ বাড়িতে কোনদিনই আমি আসতাম না, আসব না-ই ভেবেছিলাম, কিন্তু তোমার চিঠি পেয়ে আসতেই হল।
এবার আমি যাব। বড়দা বললেন শুনতে পেলাম।
দাদা?
বল? বড়দার গলা।
বাবাকে তুমি ত্যাগ করেছ বড়মার ওপরে অন্যায় করেছিলেন বলে। সে ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে চাই না, কিন্তু আমরা ভাইবোনেরা তো কোন অপরাধ করিনি তোমার কাছে?
আমাদের কেন ত্যাগ করলে?
বড়দার গলা শোনা গেল আবার, তোমাদের তো আমি ত্যাগ করিনি ভাই। ত্যাগ করলে কি আসতাম আজ তোমার চিঠি পেয়ে। কিন্তু আর নয় ভাই, এবারে আমি যাব।
স্বাতী বললে, তখনি দরজার পাশ থেকে উঁকি দিয়ে বড়দাকে আমি দেখি। দাদা বড়দাকে প্রণাম করল। বড়দা দাদার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন।
তারপর?
বড়দা বললেন দাদাকে, আসার কথা যেন কেউ না জানতে পারে নির্বাণী।
কেউ জানবে না দাদা।
না, বোনেদেরও বলল না।
না, বলব না। আমি তুমি আসবে ফোনে সেদিন হাসপাতালে বলার পরই এই ঘরের রাথরুমের দরজাটা খুলে রেখে দিয়েছিলাম আজ সন্ধ্যাবেলাতেই। চল ঐ পথ দিয়েই তোমায় বের করে দেব। স্বাতী তার কথা শেষ করে একটু থামল, তারপর আবার বললে, আর একটা কথাও আপনার জানা দরকার কিরীটীবাবু।
বলুন?
বড়দা বৌদিকে দেবার জন্য দাদার হাতে যে প্রেজেনটেশনটা দিয়ে গিয়েছিলেন, একটা সোনার হার, সেটা আমার কাছেই আছে।
আপনার কাছে?
হ্যাঁ, দাদা বড়দাকে নিয়ে বের হয়ে যাবার পর ঘরে ঢুকে আমি একটা ভেলভেটের কেস বিছানার ওপর পড়ে থাকতে দেখে সেটা তুলে নিই।
তারপর?
নীচে নিয়ে এসেছিলাম বৌদির গলায় পরিয়ে দেব বলে, কিন্তু লোকজনের আসা-যাওয়ার জন্য সুযোগ পাইনি। সেটা আমার কাছেই আছে। কথাগুলো বলে স্বাতী কেমন যেন ইতস্তত করতে থাকে। মনে হয় কিরীটীর, স্বাতীর যেন আরো কিছু বলার আছে কিন্তু বলতে পারছে না।
আর কিছু বলবেন স্বাতীদেবী?
কিরীটীবাবু!
বলুন?
দাদাকে বড়দা খুন করতে পারে বলে আপনার বিশ্বাস হয়?
না। আপনার দাদাকে আশুবাবু খুন করেননি।
আঃ, আপনি আমাকে বাঁচালেন কিরীটীবাবু। আমার স্বামীর ধারণা বিষয়ের লোভে বড়দাই দাদাকে–
পরেশবাবু, নির্বাণীবাবুর হত্যাকারী আশু মল্লিক নন।
আপনি বুঝতে পেরেছেন কে হত্যাকারী? পরেশ ভৌমিক জিজ্ঞাসা করলেন।
পেরেছিলাম গতকালই, এখন নিঃসন্দেহ হলাম।
কে–কে হত্যাকারী?
ক্ষমা করবেন মিঃ ভৌমিক, সবটাই আমার অনুমান এখনও। অনুমানের ওপর নির্ভর করে তো একজনের হাতে হাতকড়া পরানো যায় না। প্রমাণ-প্রমাণের দরকার, কাজেই যতক্ষণ না সেই প্রমাণ আমার হাতে আসছে কিছুই বলতে পারব না।
অতঃপর স্বাতী ও পরেশ ভৌমিক বিদায় নিল। একটু পরে কৃষ্ণা ঘরে ঢুকে দেখল, কিরীটী ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে।
ওরা কি বলতে এসেছিল গো? কৃষ্ণা শুধাল।
ওরা যা বলে গেল, মানে স্বাতীদেবী, অর্থ হচ্ছে হতভাগ্য নির্বাণীতোষ নিজেই তার হত্যাকারীর আসবার পথটা খুলে রেখেছিল।
সে কি!
হ্যাঁ। সত্যিই ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! জান সে রাত্রে আশু মল্লিক তার ভাতৃবধূকে আশীর্বাদ করতে এসেছিল।
আশু মল্লিক, সত্যি-সত্যিই এসেছিল তাহলে?
হ্যাঁ, কিন্তু—
কি?
দুভাগ্যই বলতে হবে। বাপ ও ছেলের মধ্যে পুনর্মিলনের যে ক্ষীণ সম্ভাবনাটুকু ছিল, নির্বাণীতোষের মৃত্যুতে তাও আর রইল না। বাপ ও ছেলের মধ্যে যে সেতুটা গড়ে উঠছিল, সেটা বোধ হয় চিরদিনের মতই ভেঙে গেল।