কারণ কিরীটীর মন কেন যেন প্রথম থেকেই বলছে, দীপিকা হয় হত্যাকারীকে দেখেছিল বা সে বাথরুমে এমন কিছু দেখেছিল যেটা তার মানসিক ভারসাম্য হারাবার কারণ হয়েছিল।
হত্যাকারী কি তখনো বাথরুমের মধ্যেই ছিল? তাই যদি হয় তো, ময়না তদন্ত রিপোর্টে যেমন নিবণীতোষের মৃত্যুর সময় বলছে—সেটা ঠিক নয়, হয়তো দীপিকা ঘরে ঢোকার পরই হত্যাকারী নির্বাণীতোষকে হত্যা করেছে। কিন্তু তাহলে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, হত্যাকারী বাথরুমের মেথরদের যাতায়াতের দরজাটা খুলে পালাল না কেন? আর তা যদি না পালিয়ে থাকে তো কোন্ রাস্তা দিয়ে সে পালাল? সিঁড়িপথ দিয়ে নিশ্চয়ই নয়?
কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকল, হাতে কফির কাপ।
কফির কাপটা কিরীটীর হাতে তুলে দিয়ে সামনের সোফাটার উপরে বসতে বসতে কৃষ্ণা বলল, দেখ, আমার একটা কথা কাল রাত্রে শুয়ে শুয়ে মনে হচ্ছিল—
কি কথা? কিরীটী স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল।
হত্যাকারীকে দীপিফা বোধ হয় দেখতে পেয়েছিল, শুধু তাই নয়, চিনতে পেরেছিল তাকে।
তার মানে তুমি বলতে চাও কৃষ্ণা, হত্যাকারী দীপিকার কোন পরিচিত জন?
মনে হয় তাই।
হওয়াটা অসম্ভব নয়। তবে পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট যদি সত্যি বলে ধরে নিই, তাহলে হত্যাকারীর তখন সেখানে উপস্থিত থাকাটা কোন যুক্তিবিচারেই গ্রহণযোগ্য নয়।
কেন?
কারণ দীপিকা ওপরে গিয়েছিল পৌনে বারোটা নাগাদ, তারপর ব্যাপারটা আবিষ্কৃত হয় এবং পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে পৌনে এগারোটা থেকে পৌনে বারোটা ঐ এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই কোন এক সময় নির্বাণীতোষকে হত্যা করা হয়েছে। খুব সম্ভবত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। তাই যদি হয়, তবে হত্যার পর আধ ঘণ্টা পনের কুড়ি মিনিট হত্যাকারী বাথরুমে থাকবে কেন?.কাজ শেষ হবার পর তো তার চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
তা স্বাভাবিক, তবে এমনও তো হতে পারে—
কি?
কোন্ পথে পালাবে, কোন্ পথে পালালে যে কারো নজরে পড়বে না সেটা ভাবতে তার কিছু সময় গেছে।
তারপর? পালাল কোন্ পথে? বাথরুমের মেথরদের যাবার দরজা তো বন্ধ ছিল, আর সিঁড়ি দিয়ে পালালে সবার চোখে পড়ে যেত তখন।
পাশের ঘরের সংলগ্ন বাথরুম নেই?
কিরীটী যেন কৃষ্ণার কথায় চমকে উঠে বললে, ঠিক বলেছ! সে ঘরটা তো দেখিনি! বলেই সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে কিরীটী শিবতোষের বাড়িতে ফোন করল।
শিবতোষ বাড়িতে ছিলেন না। ফোন ধরল তাঁর ছোট মেয়ে স্বাতী, কে?
আমি কিরীটী রায়, আপনি কে?
স্বাতী।
স্বাতী দেবী, আমাকে একটা সংবাদ দিতে পারেন?
কি বলুন?
আপনার দাদা তিনতলায় যে পাশাপাশি দুটি ঘর ব্যবহার করতেন, তার দুটো ঘরেই কি সংলগ্ন বাথরুম আছে?
আছে। ওপরের সব ঘরেই সংলগ্ন বাথরুম আছে, একটা ঘর বাদে।
সে বাথরুমেও নিশ্চয়ই মেথরদের যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে?
পেছনের দিকে একটা সরু ফালি বারান্দা আছে, সেই বারান্দা দিয়েই প্রত্যেকে বাথরুমে ঢোকে, মেথরের সিঁড়িটা লোহার ঘোরানো।
ওপরে গিয়ে চট্ করে একবার দেখে আসবেন, সেই পাশের ঘরের বাথরুমের দরজাটা খোলা মা বন্ধ?
ধরুন, দেখে এসে বলছি।
মিনিট দশেক বাদেই স্বাতী এসে বলল, দরজাটা বন্ধ আছে।
আর একটা কথা, সে রাতের পর কেউ কি তিনতলায় আর গিয়েছে?
না। কেউ যায় না আর ওপরে। মেথররাও না?
না।
কেন?
বাবা বারণ করে দিয়েছেন। ওপরের সব ঘরেই এখন তালা দেওয়া।
বৌদি কেমন আছেন?
সেই রকম।
কিছুই মনে করতে পারছেন না?
না।
ধন্যবাদ। কিরীটী ফোনটা রেখে দিল।
উঃ কৃষ্ণা, তোমার জন্যই রহস্যের রীতিমত শক্ত জট খুলে গেল। কেবল সেদিন থেকে অন্ধকারে হাতড়ে মরছিলাম, অথচ একবারও দ্বিতীয় ঘটনার কথা মনে হয়নি, আশ্চর্য! এতবড় একটা ভুল হল লে আমার? মাথার বস্তুগুলো বোধ হয় সব ফসিল হয়ে গিয়েছে আমার কৃষ্ণা Must retire now, কিরীটীর ছুটি এবারে—
না, কিছুই হয়নি—সব ঠিক আছে।
তবে কথাটা মনে পড়ল না কেন? বুড়ো হয়ে গিয়েছি কৃষ্ণা-বুড়ো হয়ে গিয়েছি, সকলকে প্রণাম জানিয়ে এবারে ছুটি নেব।
হয়ত পরে মনে পড়ত, কৃষ্ণা মৃদু হেসে বলে।
স্বামীকে স্তোক দিচ্ছ?
না গো না। কিরীটী রায় তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কিরীটী রায়ই থাকবে, কিন্তু কফিটা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল!
যাক। জটটাও খুলেছে, আর সেই সঙ্গে এখন যেন অন্ধকারে একটু একটু করে আলোও ফুটে উঠেছে।।
০৯. ঐদিনই বিকেলের দিকে
ঐদিনই বিকেলের দিকে।
খোলা জানলাপথে মৃদু মৃদু প্রথম বসন্তের হাওয়া আসছে।
কৃষ্ণা আর কিরীটী তাদের বসবার ঘরে বসে গল্প করছিল। জংলী এসে ঘরে ঢুকল, বাবুজী!
কিরে?
একজন ভদ্রমহিলা আর একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
কোথা থেকে এসেছে? নাম কি?
বলতে বললেন শিবতোষবাবুর মেয়ে।
যা, এই ঘরে নিয়ে আয়।
একটু পরে ঢুকল স্বাতী ও দামী সিল্কের সুট-পরিহিত সুদর্শন এক ভদ্রলোক, বয়স আটাশ-ঊনত্রিশ হবে।
আসুন।
নমস্কার। আমার নাম পরেশভৌমিক, স্বাতী আমার স্ত্রী,কলকাতা হাইকোর্টে আমি প্র্যাকটিস করি। বার-এট-এল। আপনিই তো মিঃ রায়!
হ্যাঁ বসুন, নমস্কার।
ওঁরা দুজন বসলেন। তারপর পরেশ ভৌমিক বললেন, দেখুন মিঃ রায়, আপনি হয়ত আমাদের দুজনের এভাবে আসায় একটু অবাকই হয়েছে, ভাবছেন কেন এলাম—
না না, তা কেন—
এসেছি এইজন্য যে, আমার স্ত্রী স্বাতী সেদিন আপনার কাছে যে স্টেটমেন্ট দিয়েছিল তার মধ্যে একটা মিথ্যা ছিল, শুনে আমি ওকে নিয়ে এলাম, মিথ্যাটা সংশোধন করে নেবার জন্য।