কি বলছেন আপনি? সঞ্জীব প্রতিবাদ জানায়।
কথাটা যে মিথ্যা নয়, আমার অনুমান হলেও সেটা আপনারা প্রত্যেকেই জানেন। আর এও আমি বলছি, আপনাদের মধ্যে কেউ একজনও এও জানেন—নির্বাণীতোষের হত্যাকারী কে।
সঞ্জীব আবার প্রতিবাদ জানায়, আমরা জানি?
হ্যাঁ। তার প্রমাণ, কেউ আপনারা সত্যি কথা বলতে নারাজ। এবং কতকটা ইচ্ছা করেই সত্যি কথা প্রকাশ করছেন না। রাত দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত আপনারা কে কোথায় ছিলেন? আজ আমি উঠছি, আপনাদের আর ডিটেন করব না, কিন্তু আবার আমাদের দেখা হবে। নমস্কার।।
০৮. কিরীটী কথাগুলো বলে
কিরীটী কথাগুলো বলে সহসা কতকটা যেন নাটকীয়ভাবেই চেয়ার থেকে উঠে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর ওরা চারটি প্রাণী স্তব্ধ অনড় হয়ে যেমন বসে বা দাঁড়িয়ে ছিল তেমনই রইল।
হঠাৎ একসময় ঘরের অসহনীয় স্তব্ধতা ভঙ্গ করে পরেশই বলে উঠল, ফ্যানটাসটিক্–রিডিকুলাস! ভদ্রলোকের ওপরে আমার সত্যিই কিছুটা শ্রদ্ধা ছিল, এখন দেখছি মানুষটা একটা পুরোপুরি হামবাগ! শেষ পর্যন্ত কিনা ধারণা হল তার—আমরাই, মানে আমাদের মধ্যে কেউ একজন সে-রাত্রে নির্বাণীকে হত্যা করেছি আর আমাদের মধ্যে একজন তাকে চেনে বা দেখেছে।
ক্ষীণ গলায় শিখেন্দু বললে, কিন্তু এটা তো ঠিক, কেউ আমরা সত্যি স্টেটমেন্ট দিইনি!
মানে? আমরা মিথ্যে বলেছি? পরেশ রাগত কণ্ঠে শুধাল।
তোমরা বলেছ কিনা তোমরাই জান, তবে আমি বলেছি—
কি?
দশটার আগে একবার আমি ওপরে গিয়েছিলাম।
ওপরে মানে? পরেশ শুধাল।
তিনতলায় নির্বাণীর ঘরে—
সে কি? কেন?
নির্বাণী বরাবর স্পেশাল ব্রা স্টেট এক্সপ্রেস ৫৫৫ খেত তোরা তো জানিস। ওর সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল, অথচ সঞ্জীব তখনও যায়নি, তাই নির্বাণী আমাকে বলেছিল তিনতলায় গিয়ে তার ঘর থেকে দু প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসতে, নির্বাণী প্যাণ্ডেল ছেড়ে যেতে চায়নি।
তারপর?
হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চমকে সকলেই ফিরে তাকাল দরজার দিকে। কিরীটী চলে যায়নি ঘর থেকে বের হয়ে দরজার আড়ালেই চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল কারণ সে অনুমান করেছিল তার ঐ কথাগুলো বলে ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর চার বন্ধু ব্যাপারটা নিয়ে কোন-না-কোন মন্তব্য হয়তো করবেই। এবং তার অনুমানটা যে মিথ্যা নয় সেটা একটু পরেই প্রমাণিত হওয়ায় সে কান খাড়া করে ওদের কথা শুনছিল।
শিখেন্দুর শেষ কথার সঙ্গে সঙ্গেই সে সাড়া দিয়ে ঘরে এসে ঢুকল।
কিরীটীর অভাবিত অতর্কিত আর্বিভাবে চারজনই যেন বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল কয়েকটা মুহূর্তের জন্য।
পরেশই বলে, কিরীটীবাবু আপনি তাহলে যাননি?
না, পরেশবাবু। হামবাগ হলে অবিশ্যি চলেই যেতাম, কিন্তু শিখেন্দুবাবু—আপনি থামলেন কেন? একটু আগে যা বলছিলেন শেষ করুন। তারপর কখন কোন্ পথে আপনি আবার নীচের প্যাণ্ডেলে ফিরে আসেন সে-রাত্রে? প্লিজ বলুন, চুপ করে থাকবেন না!
শিখেন্দু যেন কেমন যোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।
বলুন!
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছিলাম। আস্তে আস্তে থেমে থেমে কথাগুলো বলল শিখেন্দু।
কতক্ষণ পরে?
মিনিট দশ-বারো পরেই
তবে গোকুল আপনাকে নেমে আসবার সময় দেখতে পেল না কেন?
বলতে পারব না—
কখন গিয়েছিলেন ওপরে?
রাত দশটা বোধ হয় তখন।
তাহলে নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে সেই নীলবসনা রহস্যময়ী নারীর দেখা হয়েছিল?
নীলবসনা রহস্যময়ী নারী! সে আবার কে? পরেশ হঠাৎ প্রশ্ন করল।
নির্বাণীতোষবাবুর হত্যাকারী।
কি বলছেন আপনি কিরীটীবাবু? নির্মল বলল, তাহলে কোন মহিলাই খুনী?
আপাতদৃষ্টিতে তাই বলতে পারেন।….কি শিখেন্দুবাবু, কোন স্ত্রীলোককে দেখেননি তিনতলায়, সে তো আপনার পরে-পরেই ওপরে গিয়েছিল, দেখেননি?
না—না তো বলে শিখেন্দু সকলের মুখের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকাল।
না, সত্যি বলছি মিঃ রায়, সে-সময় তিনতলায় কাউকে আমি দেখিনি।
তবে কেন আপনি ওপরে আরো একবার গিয়েছিলেন, আমার বার বার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও স্বীকার করেননি? কেন?
ভয়ে–
ভয়–কিসের ভয়?
যদি আপনি—
আপনাকে সন্দেহ করি, তাই?
হ্যাঁ।
কিরীটী কিছুক্ষণ অতঃপর তাকিয়ে রইলো শিখেন্দুর মুখের দিকে। তারপর বলল, চলুন—আপনি তো বেরুবেন, হাসপাতালে যাবেন?
হ্যাঁ।
চলুন আপনাকে আমি হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে যাব।
শিখেন্দু আর প্রতিবাদ জানাতে পারল না। কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
গাড়িতে বসে যেতে যেতে কিরীটী শিখেন্দুকে কতকগুলো কথা বলল।
শিখেন্দু শুনে গেল।
হাসপাতালের গেটের সামনে নামিয়ে দেবার সময় কিরীটী বললে, সংবাদগুলো আমার চাই যত তাড়াতাড়ি পারেন দেবেন। সোজা আমার বাড়িতে চলে আসবেন।
শিখেন্দু তখন অনেকটা আবার স্বাভাবিক বোধ করছে নিজেকে। বললে, যাব।
কিরীটীর গাড়ি চলে গেল।
ফেরার পথে কিরীটী ভবানীপুর থানায় নেমে বীরেন মুখার্জীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল। বাড়িতে এসে যখন গোঁহল, বেলা তখন সাড়ে দশটা।
ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে কৃষ্ণা শুধাল, কি ব্যাপার, সক্কাল বেলাতেই কিছু না খেয়েই কোথায় বের হয়েছিলে?
সারকুলার রোডে শিখেন্দুদের মেসে—
কিছু খাবে তত এখন?
না, এক কাপ কফি নিয়ে এস।
কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই কিরীটী সোফা-কাম-বেডটার উপর টান-টান হয়ে শুয়ে পড়ল। দীপিকার কথাই মনের মধ্যে আনাগোনা করছিল কিরীটীর। এই সময় কিন্তু দীপিকার কাছে গিয়ে কোন লাভই নেই। অতীতের সমস্ত স্মৃতি বর্তমানে তার মন থেকে মুছে গিয়েছে। ডাঃ বর্মণ যেমন বলেছেন, দীপিকার পূর্ণ স্মৃতি আবার ফিরে আসবে, কিন্তু কবে কেমন করে আসবে,তা তিনি বলতে পারেন না; তার ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে কিরীটীর চলবে না, তাই সে মনে মনে গাড়িতে আসতে আসতেই সঙ্কল্প করেছিল, দীপিকার পূর্বস্মৃতি ফিরে আসে কিনা সে-সম্পর্কে সে একবার চেষ্টা করে দেখবে।