দ্বিতীয়ত, উৎসবের রাত্রে হত্যা যেখানে সংঘটিত হয়েছে সেই তিনতলায় কেউ বড় একটা যায় নি। যারার প্রয়োজনও ছিল না। সেদিক দিয়েও হত্যার স্থানটি নিরিবিলি এবং সবার চোখের আড়ালেই ছিল। কাজেই হত্যাকারীর পক্ষে নিঃশব্দে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে চলে যাওয়া আদৌ কোন কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল না।
খুব কৌশলে এবং নিশ্চিন্তে হত্যাকারী তার কাজ শেষ করেছে ঠিকই, কিন্তু তথাপি দুটি অসঙ্গতি যেন কিরীটীর প্রথম থেকেই মনের মধ্যে তাকে কেবলই কোন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রথমত শিখেন্দুর জবানবন্দি থেকেই জানা যায়, চিৎকার শুনে ওপরে গিয়ে ওঠবার পর সে নির্বাীতোষের শয়নঘরের দরজা খোলা দেখতে পেয়েছিল। নিশ্চয়ই দরজাটা ঐ সময় খোলা ছিল, নচেৎ সে ভিতরে প্রবেশ করতে পারত না। দ্বিতীয়ত, বাথরুমের দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। একটা অবিশ্যি এর মধ্যে কথা থাকতে পারে, প্রথমটা দ্বিতীয়টার পরিপূরক হতে পারে। কিন্তু তাও তো প্রমাণসাপেক্ষ এবং সে প্রমাণ একমাত্র দিতে পারে দীপিকাদেবী, অর্থাৎ সে ঘরে ঢোকার পর ঘরের দরজা বন্ধ ছিল কিনা, যদিও সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু দীপিকা তার পূর্ণ স্মৃতি হারিয়েছে নিদারুণ মানসিক আঘাতে।
শিবতোষের ফ্যামিলি-ফিজিসিয়ান ডাঃ চৌধুরীরই অনুরোধে সিকায়াট্রিস্ট ডাঃ বর্মণকে আনা হয়েছিল। তিনি দীপিকাকে পরীক্ষা করে সেই অভিমতই নাকি প্রকাশ করেছেন। যদিও বলেছেন ডাঃ বর্মণ, দীপিকার পূর্ণ স্মৃতি আবার ফিরে আসবে, তবে কবে কখন হবে সে সম্পর্কে কোন ভবিষ্যদ্বাণীই তিনি করতে পারেননি। সেটা নাকি সম্ভবও নয়।
ডাঃ বর্ষণের কথা অবিশ্যি ঠিক, কোন নিদারুণ আকস্মিক মানসিক আঘাতের ফলেই দীপিকার ঐ মনের মানসিক বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু সেটা কি তার স্বামীকে আকস্মিক মৃত আবিষ্কার করার জন্যই, না তার সঙ্গে আরও কিছু ছিল?
কিরীটীর অনুমান আরও কিছু ছিল। এবং সে ব্যাপারটা, ওর স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর আঘাতের মতই অনুরূপ আঘাত হেনেছিল তার মনে, যার ফলে বেচারী আর তার মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে নি। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে ও স্মৃতিশক্তিও লোপ পেয়েছে তার। এবং কিরীটীর আরও অনুমান, সবই বাথরুমের মধ্যে ঘটেছিল। ঐ বাথরুমের মধ্যেই হত্যারহস্যের মীমাংসার আসল সূত্রটি অন্ধকারে দৃষ্টির অগোচরে জট পাকিয়ে আছে। এবং সে জট খুলতে হলে সর্বাগ্রে জানা প্রয়োজন, কে কে সে রাত্রে তিনতলায় গিয়েছিল? কখন গিয়েছিল? শিখেন্দু, নির্বাণীর বোন স্মৃতি, আর সেই নীলবসনা নারী।
পরের দিন সকালে সারকুলার রোডে শিখেন্দুদের মেসে গিয়ে হাজির কিরীটী। সকাল সাতটার মধ্যেই গিয়েছিল কিরীটী। কারণ সে জানত দেরী করে গেলে তাদের সঙ্গে দেখা হবে না, সবাই হাসপাতালে বের হয়ে যাবে।
শিখেন্দু বরাবরই সকালে ওঠে, তার স্নান পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে ডিউটিতে যেতে হবে বলে তখন সে জামাকাপড় পরছে। সঞ্জীব সদ্য সদ্য ঘুম ভেঙ্গে একটা সিগারেট ধরিয়ে এক পেয়ালা চা নিয়ে বসেছে।
শিখেন্দুবাবু!
কিরীটীর ডাকে শিখেন্দু চোখ তুলে দরজার ওপরে দেখে বললে, কিরীটীবাবু! আসুন, আসুন। সঞ্জীব, ইনি কিরীটী রায়।
সঞ্জীবও কিরীটীর দিকে তাকাল।
নির্বাণীতোষের অন্যান্য ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে একটু পরিচিত হতে এলাম।
বসুন। শিখেন্দু বললে।
আপনি সঞ্জীববাবু?
কিরীটীর প্রশ্নে তার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে সম্মতিসূচক ঘাড় হেলাল সঞ্জীব।
আপনি তো বোধ হয় সে-রাত্রে বেলতলার বাড়িতে উৎসবে যান নি?
না।
বন্ধুর বৌভাতে গেলেন না?
আমাদের ক্লাবে সে-রাত্রে থিয়েটার ছিল।
আপনি অভিনয় করেছিলেন?
হ্যাঁ।
শিখেন্দু বললে, ও খুব ভাল অভিনয় করে কিরীটীবাবু।
তাই বুঝি? তা সে-রাত্রে আপনাদের কি নাটক অভিনয় হল?
বহ্নিশিখা। শিখেন্দু বললে।
কল্যাণীর পার্ট করেছি। সঞ্জীব বললে।
শিখেন্দু বললে, ও খুব চমৎকার ফিমেল রোল করে কিরীটীবাবু।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, সে ওঁর গলার স্বর ও চেহারা থেকেই বোঝা যায়। আজকাল তো ফিমেল বোল সর্বত্র মেয়েরাই করে শুনেছি।
আমাদের ক্লাবে এখনও কোন ফিমেল নিয়ে আমরা অভিনয় করিনি।
সঞ্জীবের কথা শেষ হবার আগেই বাইশ-তেইশ বছরের এক তরুণ ছোকরা ঘরে এসে ঢুকলীরোগা পাতলা চেহারা, মাথায় বড় বড় চুল, মুখের গঠনটা যেন ঠিক মেয়েদের মত।
সঞ্জীববাবু!
কে–ও তপনবাবু?
আমার পুরো টাকাটা তো সে-রাত্রের এখনও পেলাম না।
কেন, হিমানীশ দিয়ে দেয়নি?
না। বললেন, আপনার সঙ্গে আগে কথা বলবেন তারপর। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার কথা ছিল সেই রাত্রেই টাকাটা মিটিয়ে দেবেন।
ছেলেটির গলার স্বর অবিকল মেয়েদের মত।
সঞ্জীব বললে, কত বাকি আছে?
পঞ্চাশ।
সঞ্জীব উঠে গিয়ে জামার পকেট থেকে পার্সটা বের করে দশ টাকার পাঁচখানা নোট তপনকে দিয়ে বললে, এই নিন, এখন যান, আমরা একটু ব্যস্ত আছি।
ধন্যবাদ, নমস্কার।
তপন চলে গেল। শুধু চেহারা এবং কণ্ঠস্বরই নয়, চলার ভঙ্গীও তপনের ঠিক মেয়েদের মত। কিরীটী নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল তপনের গমনপথের দিকে। তপন ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর কিরীটী সঞ্জীবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, ভদ্রলোক কে?
তপন শিকদার। যাত্রাদলে অভিনয় করে। মৃদুকণ্ঠে বললে সঞ্জীব।
কোন্ যাত্রার দলে?
নবীন অপেরায়।
কিরীটী আবার শিখেন্দুর মুখের দিকে তাকাল, শিখেন্দুবাবু, পরেশবাবু আর নির্মলবাবু কোন্ ঘরে থাকেন?