হঠাৎ ঐ সময় প্রশ্ন করল কিরীটী, তাহলে আপনি সে-রাত্রে কলকাতায় যান নি?
না—না।
তবে কোথায় ছিলেন রবিবার রাত্রে? আপনি তো রবিবার বিকেলেই বের হয়ে গিয়েছিলেন?
কে বললে?
জানি আমি, যার সঙ্গে ট্রেনে আপনার দেখা হয়েছিল রবিবার—
আমি টালিগঞ্জে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম।
কি নাম তাঁর? ঠিকানা কি তাঁর?
কেন বলুন তো? অত সংবাদে দরকারটা কি আপনার? আপনি কি পুলিসের লোক?
না, সে-সব কিছু নয়, এমনিই জিজ্ঞাসা করছিলাম।
ঐ কথাটা জিজ্ঞাসা করবার জন্যই কি এসেছেন আজ?
না না।
দেখুন মশাই, আমি ঘাস খাই না। এতক্ষণে আপনার এখানে আগমনের হেতুটা আমি বুঝতে পেরেছি। আশা করি আপনার যা জানবার ছিল জানা হয়ে গিয়েছে। এবারে দয়া করে উঠবেন কি-আমার এটা বিশ্রামের সময়।
কিরীটী বুঝতে পারে, আশু মল্লিক আর মুখ খুলবে না। ঝোঁকের মাথায় যতটুকু বলেছে—আর সে কিছু বলবে না।
আচ্ছা, তাহলে উঠি। নামটা আমার নিশ্চয়ই মনে থাকবে আপনার, কিরীটী রায়। নমস্কার। কিরীটী চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
বাবা শিবতোষ মল্লিকের প্রতি তাঁর সন্তান আশুতোষ মল্লিকের ঘৃণা ও আক্রোশের। সত্যিকারের কারণটা যেন আর অতঃপর অস্পষ্ট থাকে না কিরীটীর কাছে। ঘৃণা আর আক্রোশের মূলে কত বড় যে একটা ব্যথা পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে আশু মল্লিকের বুকের মধ্যে, আজ কিরীটী সেটা উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছিল বাপ আর ছেলের মধ্যে আবার মিলন ঘটানো সহজসাধ্য হবে না।
শিবতোষ মল্লিকের জন্য কিরীটীর দুঃখই হয়।
গাড়িটা অনেকটা দূরে বড় রাস্তার উপর একটা গাছের নিচে পার্ক করা ছিল। ফিরে এসে গাড়িতে উঠে হীরা সিংকে বললে, চল সর্দারজী।
কোঠি তো সাব?
হ্যাঁ।
চলমান গাড়িতে বসে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে কিরীটী নতুন করে আবার যেন নির্বাণীতোষের হত্যারহস্যের ব্যাপারটা ভাববার চেষ্টা করে। নিঃসন্দেহে নির্বাণীতোষের নিষ্ঠুর হত্যার পিছনে একটা উদ্দেশ্য রয়েছে এবং সেটা বেশ জটিলই সেই জটিলতারই একটা সূত্র ছিল আশু মল্লিককে ঘিরে জট পাকিয়ে।
আশু মল্লিকের জটটা খুলবার জন্যই আজ সে আশু মল্লিকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। জটটা সবটা না খুললেও কিছুটা খুলেছে। এবং যতটুকু খুলেছে তাতেই আপাতত কিরীটী অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারে।
নির্বাণীতোষের সহপাঠীদের একবার যাচাই করে দেখা দরকার। বিশেষ করে তিনজনকে, শিখেন্দুকে আপাতত বাদ দিলে সঞ্জীব, নির্মল ও পরেশ। ওদের মধ্যে একজন উৎসবের রাত্রে বেলতলার বাড়িতে আসেনি—সঞ্জীব।
বাকি দুজন এসেছিল। পরেশ ও নির্মল। অবিশ্যি স্বাতী বা স্মৃতি কেউই পরেশের কথা বলেনি। বলেছে সঞ্জীব ও নির্মলের কথাই। তারা নাকি নির্বাণীদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করত।
কিন্তু গোকুল চিনতে পেরেছে পরেশকে। কেমন করে চিনল? হয়ত আগে না গেলেও, ইদানীং দু-একবার পরেশ নির্বাণীতোষদের বাড়িতে গিয়েছে, নচেৎ গোকুল তাকে চিনবে কি করে?
শিখেন্দুকে একবার গোকুল তিনতলায় যেতে দেখেছিল এবং তা যদি সত্য হয়, তাহলে শিখেন্দু দুবার উপরে গিয়েছিল সে-রাত্রে। অথচ শিখেন্দু অস্বীকার করেছে। সে বলেছে, একবারই নাকি সে উপরে গিয়েছে।
গোকুলের কথাটা কিরীটীর মিথ্যা বলে মনে হয় না। তারও ধারণা, শিখেন্দু দুবারই উপরে গিয়েছিল। কেন তবে অস্বীকার করছে শিখেন্দু প্রথমবার উপরে যাবার কথাটা! গোকুলের জবানবন্দি সত্য হলে, রাত দশটা কি তার দু-চার মিনিট আগে প্রথমবার শিখেন্দু উপরে গিয়েছিল। এবং গোকুল শিখেন্দুকে নেমে আসতে দেখেনি। আরও একটা ব্যাপার, শিখেন্দু উপরে যাবার মিনিট পনের কুড়ি পরে নটা চল্লিশে সেই নীল শাড়ি পরা বৌটি উপরে গিয়েছিল। গোকুল তার কোন পরিচয় দিতে পারেনি, চিনতেও পারেনি তাকে মাথায় ঘোমটা থাকার দরুন। এবং গোকুল সেই নীল শাড়ি পরা মেয়েটিকে নেমে আসতে দেখেনি। কে সেই নীলবসনা নারী!
দুজনেই—শিখেন্দু ও সেই নারী আগে-পিছে উপরে গিয়েছিল। অথচ তাদের কাউকেই গোকুল নিচে নেমে আসতে আবার দেখেনি।
সেই নীলবসনা নারীর কথা বাদ দিলেও শিখেন্দু নেমে এসেছিলই, কারণ পৌনে এগারটা নাগাদ সে প্যাণ্ডেলে উপস্থিত ছিল ও নির্বাণী তার মাথা ধরেছে বলায় তাকে উপরে চলে যেতে বলেছিল।
শিখেন্দু তাহলে কখন নীচে নেমে এসেছিল এবং কোন্ পথে?।
০৭. কিরীটীর মনের মধ্যে চিন্তাস্রোত
কিরীটীর মনের মধ্যে চিন্তাস্রোত অব্যাহত থাকে।
পৌনে এগারোটা থেকে পৌনে বারোটার কিছু আগেই মনে হচ্ছে নির্বাণীতোষকে হত্যা করা হয়। খুব সম্ভবত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টও সেই রকমই বলেছে। ঐ সময়ের মধ্যেই নাকি নির্বাণীতোষের মৃত্যু হয়েছে বলে তাদের অনুমান। হত্যাকারীর পক্ষে উৎসবের রাত্রে বিশেষ যে সুবিধা দুটি ছিল তা হচ্ছে : প্রথমত সে রাত্রে বাড়িতে উৎসবের জন্য দ্বার ছিল অবারিত। কত লোক যে এসেছিল তার সঠিক বিবরণ কারও পক্ষেই দেওয়া সম্ভব নয়। এবং সকলকে চেনাও সকলের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেই ভিড়ের মধ্যে হত্যাকারী চেনা হোক বা অচেনা হোক, কারও মনেই কোন সন্দেহ জাগবার হেতু ছিল না। অন্ততঃ সেদিক দিয়ে হত্যাকারী খুবই নিশ্চিত ছিল, কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। অনায়াসেই সে কাজ হাসিল করে চোখের সামনে দিয়েই বের হয়ে যেতে পারবে সে জানত আর তাই সে সম্ভবত গিয়েছেও।