পরনে মিলেরই প্যান্ট ও শার্ট, বোধ হয় ফিরে এসে তখনও জামা কাপড় বদলাবারও সময় পায় নি। শিবতোষের গায়ের বর্ণ বেশ কালোই বলতে হবে, কিন্তু আশুর মুখের গঠন, চোখ মুখ নাক চোয়াল ঠিক যেন তার বাপেরই মত।
কোথা থেকে আসছেন? কি নাম আপনার-আমার কাছে কি প্রয়োজন বলুন তো?
কিরীটী হেসে ফেললে, আমি কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি আশুবাবু। আমার নাম কিরীটী রায়। কলকাতা থেকে আসছি।
কলকাতা থেকে–তা আমার কাছে কি প্রয়োজন বলুন তো? চিনলাম না আপনাকে—
আপনি শিবতোষ মল্লিকের—
কিরীটীকে তার কথা শেষ করতে দিল না আশু, রুক্ষ কণ্ঠে প্রতিবাদ করে বলে উঠল, কে শিবতোষ মল্লিক আমি চিনি না, তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আপনি আসতে পারেন। গলার স্বরে রুক্ষতা ও রীতিমত বিরক্তিই যেন ঝরে পড়ল।
শিবতোষ মল্লিকের প্রথম পক্ষের সন্তান আপনি। আপনি সেটা স্বীকার না করলেও লোকে তাই বলবে।
লোকে কাকে কি বলল না বলল তা নিয়ে আমার এতটুকু মাথাব্যথা নেই মশাই। আমি জানি সে আমার কেউ নয়, তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্কই নেই। বলুন তো সত্যিই কি জন্য আমার কাছে আপনি এসেছেন?
আমি জানি আশুবাবু, আপনার স্বর্গীয়া জননীর প্রতি অবিচার এবং অত্যাচার হয়েছে—
অবিচার! অত্যাচার! কোন ভদ্রলোক যে কোন ভদ্রমহিলার সঙ্গে, বিশেষ করে যিনি সে-বাড়ির বধূ—অমন জঘন্য কুৎসিত ব্যবহার করতে পারে, যা অতিবড় ছোটলোক, অশিক্ষিতেরাও করে না—
আমি জানি।
কিছুই জানেন না আপনি—
অবিশ্যি লোকের মুখে যা শুনেছি।
কি শুনেছেন?
তাঁকে তাঁর শ্বশুর রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিক স্বীকার করে নেননি।
কিন্তু অপরাধটা কোথায়? তার ছেলেই তো–
জানি পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন আপনার মাকে–
তাই বুঝি আমার নমাসের গর্ভবতী মা যখন তার দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, চার মাস স্বামীর কোন রকম সংবাদ বা চিঠিপত্র না পেয়ে, রায়বাহাদুর বাপ মুখের ওপর তার দরজা বন্ধ করে দিল! ছেলে-তাঁর স্বামী দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। আমার মা তো আশ্রয়ভিক্ষা করতে সেখানে যাননি, কেবলমাত্র স্বামীর সংবাদ নিতেই গিয়েছিলেন
সত্যি বলছেন আপনি আশুবাবু?
কিরীটী বুঝতে পারছিল, শিবতোষ মল্লিক সব সত্যি কথা বলেননি তাকে।
হ্যাঁ, একবর্ণও মিথ্যা নয়। সেই কাপুরুষ-মহাপুরুষকেই আপনি জিজ্ঞাসা করবেন, ঐ ভণ্ডটাকে আমি একদিন গলা টিপে হত্যা করব, তারপর ফাঁসি যাব। একটা আগ্নেয়গিরির মতই যেন ফুঁসতে লাগল আশু।
আপনি বোধ হয় তাই কখনও তাঁকে স্বীকার করেননি এবং তাঁর গৃহেও যাননি!
যে বাড়ির দরজা থেকে আমার নিরপরাধিনী মাকে অপমান আর লজ্জা মাথায় করে নিয়ে আসতে হয়েছে, সে বাড়ির দরজাও আশুতোষ মাড়ায় না।
তবু আইনে বলে, আপনিই তাঁর একমাত্র বংশধর এখন—
কোন দুঃখে! তার দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেই তার বংশধর। আমি তাকে স্বীকারও করি, আমার সঙ্গে তার কোন সম্পর্কই নেই।
আপনি জানেন একটা কথা, তাঁর সে ছেলেটি রবিবার খুন হয়েছে?
হয়েছে, ঠিক হয়েছে—এবার ওকেও হতে হবে। আপনি কি ঐ সংবাদটি দিতেই এখানে এসেছেন কলকাতা থেকে? তাহলে জেনে যান, আমি খুব খুশি হয়েছি।
কিন্তু নির্বাণীতোষবাবু তো আপনার কখনও কোন ক্ষতি করেননি আশুবাবু! তাছাড়া তাঁর বাপের কর্মের জন্যও নিশ্চয়ই তিনি দায়ী নন। এবং শুনলে বিশ্বাস হয়ত করবেন না , তিনি আপনাকে দাদার মতই শ্রদ্ধা করতেন, ভালবাসতেন।
কিরীটীর ঐ কথায়, বিশেষ করে তার শেষের সম্পূর্ণ বানানো কথাগুলিতে হঠাৎ যেন মনে হল আশুতোষ একটু বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কোন কথা বলে না। চুপ করে থাকে।
আরও আপনি হয়ত জানেন না, দুর্ঘটনার মাত্র দুদিন আগে নির্বাণীতোষবাবু বিয়ে। করেছিলেন। রবিবার রাত্রে তিনি খুন হন, সে রাত্রে ছিল বৌভাত ও ফুলসজ্জা তাঁর।
আশুতোষ পূর্ববৎ নির্বাক।
হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করল, আপনাকে নিমন্ত্রণ করেননি?
করেছিল।
করেছিলেন নিমন্ত্রণ?
হ্যাঁ।
কে নিমন্ত্রণ করেছিলেন?
রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিকের ছেলে, আপনাদের শিবতোষ মল্লিক নন—
তবে কে?
নির্বাণীতোষই একট চিঠি পাঠিয়েছিল।
নির্বাণীতোষবাবু আপনাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন নিজে?
হ্যাঁ।
আছে সে চিঠি?
আছে বোধ হয়।
দেখতে পারি চিঠিটা একবার?
আলমারিটা খুলে–বইয়ের উপরে রাখা ছিল চিঠিটা, সেটা বের করে দিল আশুতোষ কিরীটীর হাতে।
ডাকে এসেছে, খামের চিঠি।
খামটা থেকে চিঠিটা বের করে পড়ল কিরীটী। সংক্ষিপ্ত চিঠি। চিঠির তারিখ দিন-পাঁচেক আগের।
শ্রীচরণেষু দাদা,
আপনি আমাকে কখনও স্বীকার না করলেও চিরদিন আপনাকে আমি আমার জ্যেষ্ঠ বলেই জেনে এসেছি। আর পাঁচদিন পরে—শুক্রবার আমার বিয়ে। আপনি আসবেন না আমি জানি, তাই এই পত্রে আপনার আশীর্বাদ চেয়ে নিচ্ছি। প্রণত—নির্বাণীতোষ।
চিঠিটা পড়া শেষ হলে পুনরায় সেটা খামের মধ্যে ভরতে ভরতে কিরীটী বললে, কবে এ চিঠি পেয়েছেন আপনি?
গত শনিবার।
চিঠির জবাব—
না, দিইনি। তাদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্কই নেই।
আপনি তো শুনেছেন আশুবাবু, রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিক কি প্রকৃতির লোক ছিলেন। আপনার জন্মদাতা হয়তো নিরুপায় হয়েই
একটি ভদ্রঘরের নিরপরাধ মেয়েকে বিয়ে করবার সময় সেকথা তার মনে ছিল না? মেরুদণ্ডহীন অথর্ব পশু একটা! আবার যেন আশুতোষ আক্রোশে ফেটে পড়ল।
তাহলে তাঁরও তো কিছু বলবার থাকতে পারে—
থাকুক, তা দিয়ে আমার কোন দরকার নেই।