দেখ পরেশ, তোর ডিটেকটিভ বই পড়ে পড়ে মাথাটাই দেখছি বিগড়ে গেছে। নির্মল বললে, এই ধরনের সব লুজ টকস্ সময়বিশেষে কত সাংঘাতিক মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে জানিস!
সে তুই যাই বল্ নির্মল, সন্দেহের তালিকা থেকে আমরা তিনজন—বিশেষ করে নির্বাণীর বন্ধুদের মধ্যে বাদ পড়ব না।
ইডিয়ট! নির্মল বললে।
পরেশ কিন্তু নির্মলের গালাগালিটা গায়ে মাখে না। হাসতে থাকে।
মেসের ভৃত্য চরণ এসে ঘরে ঢুকল, আমাকে ডাকছিলেন শিখেন্দুবাবু?
হ্যাঁ, সামনের রু হটার কেবিন থেকে গরম দুটো টোস্ট আর এক কাপ চা নিয়ে এসো তো চরণ।
ঐ সঙ্গে আমার জন্যও এক কাপ চরণদাস, সঞ্জীব বললে।
চরণদাস ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ঘরের আবহাওয়াটা যেন হঠাৎ কেমন থমথমে হয়ে গিয়েছে। কারও মুখেই কোন কথা নেই। এমন কি পরেশও যেন চুপচাপ।
আসলে পরেশের কথাগুলো যেন কেউই একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছে না, মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারছে না।
সকলের মনের উপরেই যেন একটা কালো সন্দেহের ছায়া ফেলেছে। ছায়াটা কালে-কালো। শিখেন্দুর একটা কথা মনে পড়ল, কিরীটী তখন বারবার প্রশ্ন করেছিল, একবার নয় দুবার, সে গত রাত্রে তিনতলায় গিয়েছিল কিনা? সত্যিই সে যায়নি, তবে কিরীটীবাবু কেন ঐ প্রশ্নটা বার বার করেছিলেন। তবে কি পরেশের কথাই ঠিক!
কিরীটীবাবু তাকেও সন্দেহ করছেন।
শিখেন্দুর ভিতরটা যেন সহসা ঠাণ্ডা হিম হয়ে আসে। একটা অজ্ঞাত ভয় যেন তার মনের ওপর চেপে বসে। সে তার বন্ধুকে হত্যা করতে পারে ভাবতে পারলেন কি করে কিরীটীবাবু!
হ্যাঁ, দীপাকে সে ভালবেসেছিল, কিন্তু যে মুহূর্তে সে বুঝতে পেরেছিল নির্বাণী দীপাকে চায় এবং দীপাও নির্বাণীকে চায় সে তো সরে এসেছিল ওদের মধ্যে থেকে। খুশি মনেই সে বিয়ের উৎসবে যোগ দিয়েছিল।
পরেশই স্তব্ধতা ভঙ্গ করল, বেচারী নির্বাণীতোষ! প্রেমের পূজোয় একেবারে নির্বাণলাভ করে বসে রইল।
নির্মল চেঁচিয়ে ওঠে হঠাৎ অস্বাভাবিক গলায়, তুই থামবি পরেশ!
পরেশ বলল, একটা সিগারেট দে, গলাটা শুকিয়ে উঠেছে, একটু ধোঁয়া দেওয়া দরকার।
গলায় নয়, তোর মনে আগুন দেওয়া দরকার। নির্মল বললে।
সে সকলেরই একদিন দিতে হবে। পরেশ নির্বিকার কণ্ঠে বললে।
০৬. শিবতোষ মল্লিকের বেলতলার গৃহে
শিবতোষ মল্লিকের বেলতলার গৃহে যে রাত্রে দুর্ঘটনাটা ঘটে তার দিন দুই পরে।
অথাৎ রবিবার রাত্রে দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল, মঙ্গলবার সন্ধ্যার কিছু পরে জগদ্দল মিল ওয়াকার্সদের ঘিঞ্জি পাশাপাশি কোয়াটার্সগুলোর মধ্যে পনের ঘরের কোয়াটারটা খুঁজতে খুঁজতে একসময় এসে যখন পনের নম্বরের সামনে কিরীটী দাঁড়াল, ধোঁয়ায় ও সন্ধ্যার অন্ধকারে তখন সেখানে যেন শ্বাসরোধ হবার যোগাড়।
হাত দুই আড়াই প্রস্থে হবে খোয়া-বিছানো কাঁচা রাস্তা এবং রাস্তায় যে আলোর ব্যবস্থা আছে তা এত অপ্রতুল যে চট করে কোন কিছু নজরেই আসে না। ভাগ্যিস একজন ওয়াকার পনের নম্বর কোয়াটারটা দেখিয়ে দিয়েছিল—ঠিক দেখিয়েও নয়, বলে দিয়েছিল, রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে, একটা পোড়ো জমি, তারই সামনে একটা নিম গাছ, সেই নিম গাছের কাছেই শেষ কোয়াটারটাই পনের নম্বর কোয়ার্টার, আশুর। অথাৎ আশু মল্লিকের।
বিয়ে-থা করেনি লোকটা। দুটো ছোট ঘোট ঘর নিয়ে একাই থাকে আশু মল্লিক, সে-ই বলেছিল। যে লোকটি খোঁজ দিয়েছিল আশু মল্লিকের, বিনোদ দস্তিদারতার কাছেই মোটামুটি আশু সম্পর্কে জানতে পেরেছিল কথায় কথায় কিরীটী।
লেবার ইউনিয়নের আশু মল্লিক একজন কর্তাব্যক্তি। লোকটার গায়েও যেমন শক্তি তেমনি দুর্দান্ত সাহস। মারপিট করতে ওস্তাদ। তবে হ্যাঁ, নোকটার দিল আছে। ইউনিয়নের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে। মিলের কর্তাব্যক্তিরা ও বাবুরা সবাই তাকে ভয় করে রীতিমত। রাস্তার পাশেই কাঁচা ড্রেনটা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, তারই কিছু দূরে একটা বারোয়ারী জলের কল, সেখান থেকেই সবাই জল নেয়।
বাড়ির দরজাটা বন্ধ থাকলেও খোলা জানলাপথে কিরীটীর নজরে পড়ে, ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে।
কিরীটী বেশ উঁচু গলাতেই ডাকল, আশুবাবু আছেন–? আশুবাবু!
বার-দুই ডাকতেই সাড়া এল, কে?
একবার বাইরে আসবেন?
আসছি,–বলতে বলতেই প্রায় দরজা খুলে গেল। ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে খোলা দরজাপথে প্যান্ট ও শার্ট পরিহিত লম্বা-চওড়া এক ব্যক্তি এসে দাঁড়াল, কে?
আশুবাবু আছেন? আশুতোষ মল্লিক? এটা কি তাঁরই কোয়াটার?
আপনি কে?
আপনিই কি আশুবাবু?
হ্যাঁ।
আমাকে আপনি চিনবেন না। আপনার সঙ্গে আমার একটু দরকার ছিল।
কি দরকার, কোথা থেকে আসছেন? দরজার উপর দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করল আশু মল্লিক।
আপনি তো নাম বললে বা কোথা থেকে আসছি বললেও আমাকে চিনবেন না!
আসুন।
কিরীটী ভিতরে প্রবেশ করল।
ওয়াকার্সদের ছোট ছোট কোয়াটার, তবে ইলেকট্রিক আলোর ব্যবস্থা আছে। ছোট ছোট দুটো ঘর পাশাপাশি। মধ্যখানে যাতায়াতের দরজা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে।
ঘরের মধ্যে একটা চৌকি পাতা, খান-দুই বেতের চেয়ারও আছে। দেওয়ালে একটা ক্যালেণ্ডার ও একটি মহিলার এনলার্জ করা ফটো।
এক কোণে ছোট একটা কাঁচের আলমারিতে কিছু বই আছে।
বসুন।
কিরীটী একটা চেয়ারে বসল। বসে আশুতোষের দিকে তাকাল। দস্তিদার আশুর যেমন বর্ণনা দিয়েছিল ঠিক তেমনিই দেখতে আশুতোষ।
বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা, গায়ের রংটা ফসাই, একটু যেন বেশীই ফসা। বোধ হয় তার মার গায়ের রংই পেয়েছে ছেলে।